ঢাকা
১৫.৮.২০২৪
জাতির এক ক্রান্তিকালে এই ওয়েবসাইটটির পরিকল্পনা করি আমরা দুই জন এবং এতে সহযোগিতা করতে সম্মত হন বেশ কয়েকজন। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা থেকে সাহিত্যিক, গবেষক ও বিজ্ঞানী সবাই অন্তর্ভুক্ত। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট দীর্ঘ ১৪ বছর পর শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। অনেকেই এটাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে ঘোষণা করে এবং বিজয় উল্লাসের অংশ হিসেবে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কখনোই ঘটেনি।
এই অঘটনগুলোর মধ্যে প্রধান একটি ঘটনা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্মৃতি বিজড়িত ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের বাড়িটিতে অগ্নিসংযোগ করা ও পুড়িয়ে দেয়া। এই বাড়িটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের স্মৃতি রক্ষার্থে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এই বাড়িটিকে পুড়িয়ে দেবার মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশের ইতিহাসের ওপর সরাসরি আঘাত হানা হয়। এক জন দেশপ্রেমিক হিসেবে এটি মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব ছিল না। আমার বড় পুত্র এই ঘটনায় সারা রাত নির্ঘুম থাকে এবং পর দিন দুপুরের পর সে খুব কষ্ট পেয়ে বলে মা, ভাই তো বঙ্গবন্ধু জাদুঘর দেখলো না। তার কষ্ট আমার অন্তর্দহনকে জাগিয়ে দেয়। তখন মনে পড়ে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের একটি ওয়েবসাইট রয়েছে যেখানে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে জাদুঘরটিকে দেখা যায়। আমি তৎক্ষণাৎ আমার ব্যক্তিগত কম্পিউটারটি খুলি। এটি ছিল ৬ আগস্ট দুপুরবেলা। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের ওয়েবসাইটি ডাউন করে রাখা ছিল। আমি জাদুঘর সংশ্লিষ্ট আমার খুব কাছের একজনকে ফোন করি এবং জানতে পারি যারা আগুন দিতে এসেছিল তারা সবার আগে কম্পিউটারগুলো সিজ করে এবং তারপর বত্রিশে আগুন দেয়। আমরা আরো কিছু তথ্য পাই যাতে বোঝা যায় এটি পূর্বপরিকল্পিত একটি অপরাধ।
প্রযুক্তি বিষয়ে আমার তেমন দক্ষতা ছিল না কিন্তু আমি উপায় খুঁজছিলাম ওয়েবসাইটটি পুনরুদ্ধারের। এটি এমন একটি সময় যখন খুব কাছের মানুষকেও বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী দুজন সফটয়্যার ইঞ্জিনিয়র আমাদের সঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়। আমি জানতে পারি গুগল প্রতিটি ওয়েবসাইট সংরক্ষণ করে রাখে। কিন্তু এই মুহূর্তে গুগল থেকে বাংলাদেশে বসে সেটি রিস্টোর করা সম্ভব ছিল না। কারণ গুগল তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে এবং যে এই কাজটি করতে চাচ্ছে তার প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকে। সুতরাং আমরা চেয়েছিলাম কাজটি দেশের বাইরে থেকে কেউ করুক। যিনি কাজটি করতে সম্মত হন তিনি একজন নভোবিদ এবং যখন আমরা ওয়েবসাইটটি উদ্ধার করতে সক্ষম হই সেটি ছিল আমাদের প্রথম বিজয়।
আমরা আমাদের ওয়েবসাইটটির পরিকল্পনা এমন করে করি যেন স্বাধীনতার ইতিহাস বহন করছে এমন কিছুই আর ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয়। আগামী প্রজন্মের কাছে এটা ছিল আমাদের দায়বদ্ধতা।
একজন গবেষক হিসেবে এখানে স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসের বাঁক-বদলগুলো নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। ২০২৪ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসে জেন-জি প্রজন্ম স্বৈরাাচারী সরকারকে উৎখাত করার পর যে বিজয় উল্লাসে মেতেছিল তা ছিল বিধ্বংসী এবং অনেক ক্ষেত্রেই কুরুচিপূর্ণ। আমরা যদি ১৯৭১ এর বিজয় দিবস, নব্বই এর গণ-অভ্যুত্থান ও ২০২৪ এর বিপ্লবকে ধারাবাহিকভাবে দেখি তবে সত্যিকারের বিজয় উদযাপনের চিত্র কেমন হতে পারে তার একটি তুলনা করতে পারব। এবং আমাদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেখতে পারব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিটি কত নিপুনভাবে পুরো দেশে তাদের ঘৃণার বিষবাষ্পটি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। শুধু দেশে নয় ধর্মের আবরণে পৃথিবী ব্যাপী তারা একটি ধর্মপ্রাণ দেশদ্রোহী সম্প্রদায় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই পুরো গবেষণাতে তাই আমরা বর্তমান থেকে পিছিয়ে ঘটনার অন্তরালের ঘটনা অনুসন্ধান করেছি। এ কারণেই ওয়েবসাইটটির নাম ফ্ল্যাশব্যাক ৭১। তবে ইতিহাস বোঝার জন্য পলাশীর আম্রকানন থেকে বঙ্গভঙ্গ, পাকিস্তান রাষ্ট্রের উৎপত্তি, ভাষা আন্দোলন সব কিছুই এসেছে। এখানে আমরা একটি সেক্টর রেখেছি বাংলাদেশের জাতীয়। জাতীয় বিষয়গুলো কীভাবে এসেছে এবং বারবার এই বিষয়গুলোর ওপর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি কীভাবে আঘাত হেনেছে ও পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ আম। এই আম বৃক্ষের সঙ্গে বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস জড়িত। পলাশী মৌজার লক্ষবাগ আম্রকাননে বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উ-দৌলার পরাজয় ঘটেছিল ইংরেজদের হাতে। আবার বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল মেহেরপুর জেলার ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে। বর্তমানে সেটির নাম মুজিবনগর। এরকম প্রতিটি জাতীয় বিষয়ের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পৃক্ত। .বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় শ্লোগান ও জাতীয় সংবিধান বারবার আক্রান্ত হয়েছে। এই আক্রমণের পিছনে ছিল ব্রিটিশদের সেই ‘ডিভাইড এন্ড রুলস’ পদ্ধতির শাসন। হিন্দু আর মুসলিম বারবার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বলির পাঁঠা হয়েছে আর ধ্বংস হয়েছে মানবতার। ১৯৪৭ থেকে এই পর্যন্ত আমরা সেই ঔপনিবেশিক শাসনেই মধ্যেই হানাহানি আর কোন্দলে লিপ্ত আছি।
শেখ মুজিবুর রহমাকে খলনায়ক বানানোর চেষ্টা পাকিস্তান আমল থেকেই চলমান ছিল এবং এখন সেটা আরো সক্রিয় ভাবে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যক্তি শেখ মুজিব কিংবা শাসক শেখ মুজিব সব সময় নেতা শেখ মুজিবের কাছে পরাস্ত হয়েছে। তাই বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে শেখ মুজিবের অবস্থান কোনো অপশক্তিই মুছে দিতে পারবে না। ২০২৪ এর গণ-আন্দোলনের পর সামাজিক গণমাধ্যমে শেখ মুজিবের যে বিষয়গুলো সবচেয়ে সমালোচিত হয়েছে যেমন ইন্ডিয়ার দালাল, একনায়ক এইসব ভ্রান্ত ইতিহাসকে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। বাকশালের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন মত আছে। বাকশাল প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই শেখ মুজিবের মৃত্যু ঘটে। সুতরাং কেউ যদি কোনো ব্যক্তির একটি দর্শন দিয়ে তার সমগ্র জীবনের অর্জন ম্লান করে দিতে চায় তবে সেটা যে ভুল ইতিহাস বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইতিহাসের ব্যবহার সে সম্পর্কে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। আরো একটি বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়, যদি শেখ মুজিবের একনায়কতন্ত্রের কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধরে নিই তবে আরেকটি প্রশ্নের উত্থাপন সঙ্গে সঙ্গে ঘটবে। কেন শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর পরই পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন হয়ে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করা হয়? এবং শেখ মুজিবের মৃত্যুর পরেই পাকিস্তান ও সৌদি আরব ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ নামক দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়? আগস্টের পর পরই নভেম্বরে কেন জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল? বাংলাদেশ দেশটিকে শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। শেখ মুজিব কখনো তাঁর অপরাগতা ঢাকতে চেষ্টা করেননি। ১৯৭৪ এর কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে কত মানুষ মারা গিয়েছিল তিনি সংসদে তাঁর সঠিক তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সমাজে এত অন্যায়, চুরি, লুটপাট বেড়ে গিয়েছিল যে কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছিলো আর সমাজের নীচু তলার মানুষ সর্বহারা শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছিল। সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্যই তিনি সমাজতান্ত্রিক উপায়ে সমতা আনার চেষ্টা করেছিলেন। এতে আসলে দুর্বৃত্ত, কালোবাজারি ও অসাধু ব্যবসায়ীদেরই স্বার্থেই আঘাত লাগত। শেখ মুজিবুর রহমান সাংবিধানিক ভাবেই পাকিস্তানীদের দোসর যুদ্ধাপরাধীদের ভোটাধিকার ও নির্বাচনের অধিকার রোধ করেছিলেন। তাই স্বাধীন দেশে পরাজিত শক্তিরা সব সময় তার বিরুদ্ধাচরণ করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি অব্যাহত রেখেছিল।
যখন গবেষণার জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়েছি তখন একটি বিষয় পর্যালোচনা করেছি সেটি হলো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। শেখ মুজিব যখন স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনী গঠন করেন তখন তিনি পাকিস্তান ফেরত সৈন্য বা সেনা কর্মকর্তাদের বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত করেন। আবার প্রসাশনে তিনি পাকিস্তান-ফেরত অফিসারদের অভিজ্ঞতা বেশি বলে তাদের নিয়োগ দেন। ফিদেল কাস্ত্রোও বঙ্গবন্ধুকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন যে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা কাজে ভুল করলেও এক সময় তারা শিখে নেবে। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা অক্ষুন্ন থাকবে। কিন্তু সেনাবাহিনী ও প্রশাসন থেকে একটি অংশ প্রবহমান সময়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং তার পরিণতি ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবসহ ১৬ জনের মৃত্যু। জিয়াউর রহমানও যখন ক্ষমতা অধিকৃত করেন তখন তিনি কিন্তু সেনাবাহিনীতে সমতা আনেননি। বরং পাল্টাপাল্টি হিসেবে তিনি পাকিস্তান ফেরত সেনাদের বেশি গুরুত্ব দেন। জিয়াউর রহমানের পরিণতিও তাই মারাত্মক। ইতিহাস বলে যারাই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চেয়েছে তাদেরই পরিণতি হয়েছে মারাত্মক। খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ বা শেখ হাসিনা কেউ এর ব্যতিক্রম নন।
এবার আসি ভিন্ন আরেকটি প্রসঙ্গে। ২০২৪ বিপ্লব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি শ্রেণিকে পক্ষ-বিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমি একটি শ্রেণির কথা বলছি কারণ এখনো পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওঠেনি। মূলত এটি সামাজিক যোগাযোগ নির্ভর। এই পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে যে জিনিসটার অভাব ছিল প্রকট তা হলো সহনশীলতা। এখানে মত- বিরুদ্ধ মত, যুক্তি-অযুক্তি-কুযুক্তি ( আমি পাল্টা যুক্তি বলছি না), আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ ও ব্যক্তিগত আক্রমণ ছিল অনেকক্ষেত্রেই প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষপ্রসূত। আমি বিষয়গুলোকে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। যখন রাজধানী ঢাকাতে বত্রিশ পুড়ছে তখন একই সময়ে একই সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে মেহেরপুরের ৬০০ স্বাধীনতা ভাস্কর্য যেখানে দুজন পাকিস্তানী সেনার ভাস্কর্য কিন্তু দণ্ডায়মান ছিল অক্ষতভাবে। সবগুলো ঘটনার সময় পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায় এটা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্থান যারা আঘাত হেনেছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ওপর এবং মুছে দিতে চেয়েছে আমাদের অর্জনকে। প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে একটি গণবিপ্লবকে নব্য স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। সবচেয়ে দুঃখজনক গণবিপ্লবে নিহতদের জন্য যে সুশীল সমাজ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসকে বৈধতা প্রদান করতে চাইল তারাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে যারা নিহত হলো, যে সব সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলো সে সব বিষয়ে বিচারের দাবিতে সোচ্চার হলো না। বত্রিশে চার জনের আগুনে পুড়ে মৃত্যু, ট্রাফিকের কাজ করতে গিয়ে একটি শিশুর মৃত্যু এই বিষয়গুলো তাদের পরবর্তী আন্দোলনে ন্যায্য বিচারের দাবিতে অর্ন্তভুক্ত হলো না। পুরো আগস্ট মাস জুড়ে মব জাস্টিস সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে দিতে থাকে যা কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
সুশীল সমাজের অনেকেই এই ধ্বংসযজ্ঞকে অনেকভাবে স্বাভাবিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান এমনকি আওয়ামী লীগ কর্মীরা নিষিদ্ধ ছিল এই বাংলাদেশে। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধুর কবরে সামরিক প্রহরা রেখেছিল এবং কারো প্রবেশাধিকার সেখানে ছিল না। একটা সময় পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক ও গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত সব কিছু নিষিদ্ধ ছিল। এই সময়ে যে সব শিশুরা জন্মেছে তারা একটি ভুল ইতিহাস জেনে বড় হয়ে উঠেছে। আপনারা কি জানেন পাকিস্তান-বাংলাদেশের যুদ্ধকে পাকিস্তানের পাঠ্যবইতে কীভাবে উপস্থাপন করা হয়? এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সেটি জানা কঠিন কিছু নয়। আপনারা সেটা জেনে নিতে পারেন। একটা সময় আমাদের পাঠ্যবইও সেটির ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। ১৯৯৬ এর পর যেটা হয়েছে সেটা হলো ইতিহাসের দলীয়করণ অর্থাৎ খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চেয়েছেন এবং শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একমাত্র ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এরা কেউ স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন না। এর ফলে প্রতিটি প্রজন্ম ভুল ইতিহাসের বার্তা নিয়ে বড় হয়েছে। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজ উদ্দিন, তাঁদের প্রত্যেকের কাছেই বাংলাদেশ আজন্ম ঋণী।
একটি বিষয় সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন আমরা কোনো দলীয় অবস্থান থেকে কাজটি করিনি। আমাদের পক্ষ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ। স্বাধীন বাংলাদেশে যত দল-মত থাকুক মূলত এখানে দুটি পক্ষ: মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। আমাদের নতুন প্রজন্মের জানা প্রয়োজন কারা আমাদের প্রকৃত শত্রু। কীভাবে তারা সব সময় সক্রিয় ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাহলে মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন কিছুতে তারা এক হয়ে লড়াই করবে। এই লড়াই কোনো দলের স্বার্থরক্ষার জন্য হবে না। এই লড়াই হবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রক্ষার্থে।
নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্যই আমাদের এই প্রচেষ্টা।
02.11.2024
The emergence of Bangladesh as a secular and democratic nation is an ideal I hold dear. Sadly, that vision remains unfulfilled. Since August 5, 2024, we have witnessed the systematic destruction of symbols from the 1971 genocide and the war of independence—a disturbing attempt to erase the very sentiments that led to Bangladesh’s creation. Equating the 2024 uprising to 1971 is a dangerous distortion, undermining the foundation on which Bangladesh was built.
While I acknowledge that the last 16 years under the Awami League government have been less than ideal and have often criticized their policies, the current situation is unacceptable. The present government, which lacks a mandate, is banning organizations and imprisoning citizens without due cause. It is crucial to preserve the records and documentation that are being destroyed in this turmoil. The truth of Bangladesh’s history must be safeguarded for this and future generations.
৬.১১.২০২৪
১৯৬৯ সাল- আমার বয়স তখন তেরো বছর। ৬৯ সালে ছাত্র জনতার আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেলেন। বঙ্গবন্ধু খোলা ট্রাকে করে মিরপুর সড়ক ধরে যাবেন সম্বর্ধনা স্থলে। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য আজিমপুর কলোনীর বাসা থেকে ছুটতে লাগলাম- যে পথটি দিয়ে তিনি যাবেন তার কাছাকাছি, সীমানা প্রাচীর এর উপর উঠে দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রাক আসছে ধীর গতিতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমার বালিকা বেলার নায়ক দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন … আহা কী আনন্দ- কী উচ্ছ্বাস মহান নায়কের দর্শন। এ যেন আমার ছোট্ট জীবনের সমস্ত প্রাপ্তি। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু আমার হৃদয়ে,ভালোবাসায়, ধারণে।
১৯৭০ সাল। ৬৯-এর গণ আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের মগজ ধোলাই এর ফন্দি আটলেন – “দেশ ও কৃষ্টি” নামে একটি বই রচনা করে, ১৯৭০ সালে যারা নবম ও দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিল তাদের জন্য পাঠ্যসূচিতে পূর্ণ ২০০ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করলেন বইটি। প্রথম খণ্ডটি রচনা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি বিভাগের রিডার ড.সিরাজুল ইসলামকে দিয়ে ।
বই জুড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি লিপিবদ্ধ। সেখানে নেই পূর্বপাকিস্তান । বই হাতে পেয়ে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। তারা এ বইটি পাঠ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিল শিক্ষকদের। স্কুল শিক্ষক, অভিভাবকরাও এ বিষয়ে তাঁদের সমর্থন জানালেন। বইটি বাতিলের জন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমে এলো। তাঁদের সমর্থন দিল, ছাত্র সংগঠন, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো এ আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বত্র। জেলায় জেলায় এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতেও আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটল। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে ১৯৭০ সালের ২২ অক্টোবর বইটি বাতিল করলো। ৬৯ এর গণ-আন্দোলনের পর ৭০ সালে স্কুল ছাত্র–ছাত্রীদের “দেশ ও কৃষ্টি” আন্দোলন ছিল ঐতিহাসিক আন্দোলন । যদিও ইতিহাসের পাতায় তেমন করে স্থান পায়নি এ আন্দোলনের কথা। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের জানা হয়নি তাদের পূর্বসূরীদের ইতিহাস। যে ইতিহাস কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীকে।
১৯৭০ সালে “দেশ ও কৃষ্টি ” বইটি বাতিলের আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক স্কুল ছাত্র–ছাত্রী সম্পৃক্ত হয়, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের পতাকা তলে। আমি সম্পৃক্ত হয়েছিলাম পূর্ব -পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাথে। ছাত্রলীগের কনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে নিবন্ধিত হই।। ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ি। উত্তাল মার্চে প্রতিদিন ছিলাম রাজপথে মিছিলে, মিটিংয়ে। ১৯৭১ সালে ১৫ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্বে -আমাদের শেকড়ে। শেকড় বিহীন গাছ যেমন বেঁচে থাকে না, ঠিক তেমনি শেকড় উপড়ে ফেললে সে দেশের মাটি টিকে থাকতে পারে না। স্বাধীনতা উত্তর আমাদের বড় ভুল ছিল আমাদের দেশের স্বাধীনতা- বিরোধীদের সাধারণ ক্ষমা করে দেয়া।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিল—। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রেরণা ছিল ভিয়েতনাম। রাজপথে, আমরা স্লোগান দিয়েছি “হো ” চাচার পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।” ভিয়েতনামের জনতা , আমরা আছি তোমার সাথে।” তখন থেকে ভিয়েতনাম দেখার স্বপ্ন ছিল। বালিকা বেলার স্বপ্ন পূরনের জন্য ২০২৩ এ ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম। হোচিমিন শহর পরিদর্শনের সময় আমাদের গাইড ছিল ভিয়েতনামের এক স্বাধীনতা বিরোধীর নাতনি। আমাদের সে স্বাগত জানালো, welcome to Saigon. (সায়গন এর বর্তমান নাম হোচিমিন) । তখনি মনে খটকা লাগলো। মেয়েটি পরে, অবলীলায় স্বীকার করলো- তাঁর দাদা ছিল, ভিয়েতনামের স্বাধীনতা বিরোধী। ভিয়েতনাম, তাঁদের দেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের তিন পুরুষ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। তাদের অধিকার নেই, রাষ্ট্রের কোনো কাজে সম্পৃক্ত হওয়া, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। মেয়েটি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গাইড এর কাজ করছে। তাঁর নাতি এ নিষিদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে। তাঁর দাদার পাপের প্রায়শ্চিত্ত থেকে চতুর্থ পুরুষ মুক্ত হবে ।
হোচিমিন স্কয়ার আর হোচিমিন নগরী ছাড়া কোথাও, হোচিমিন এর অবয়ব মূর্তি দেখিনি। কিন্তু, ভিয়েতনামের প্রতিটি নাগরিকের ধারণে আছে হোচিমিন।
আর আমরা স্বাধীনতা বিরোধীদের ক্ষমা করে, রাষ্ট্রযন্ত্রে বসিয়েছি। দুধ কলা দিয়ে বিষধর সাপ পুষেছি, এ দেশের মাটি আলো বাতাসে খেয়ে পড়ে এ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে তাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। সুযোগ পেলেই ছোবল দিচ্ছে।
প্রথম ছোবল দিয়েছিল ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু কে সপরিবারে হত্যা করে। দ্বিতীয় ছোবল ২০০৪ এর একুশে আগস্টে। শেষ ছোবলটা দিল ২০২৪ এর ৫ই আগস্টে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হাসিনা সরকার এর পতন ঘটিয়ে, স্বাধীনতার সব স্মৃতি-চিহ্ন ধ্বংস করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক বাড়িটি তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে । ৭১ এ পাকিস্তান জালেম সরকার, ৭৫ এর হায়েনারা যা করার সাহস পায়নি তাই তারা করে দেখিয়েছে।
এ বর্বরতা যখন চলছে তখন আমি ছিলাম ইউরোপের গ্রীসের প্রাচীন শহর “আক্রোপলিসে।” খৃষ্টপূর্ব ইরান ধ্বংস করেছিল এ নগরী। গ্রীসবাসি সেই ধ্বংসাবশেষ সে ভাবেই রেখে দিয়ে তাঁদের, ধ্বংসের ইতিহাস বলে যাচ্ছে, শতাব্দী থেকে শতাব্দীর মানুষের কাছে। থাইল্যান্ডের প্রাক্তন রাজধানী আয়ুথায়া পুড়িয়ে দিয়েছিল বার্মা, বর্তমান মিয়ানমার। তাঁরা তাদের পোড়া নগরী সেভাবেই রেখে দিয়েছে। বিশ্বের পর্যটকদের কাছে “আয়ুথায়া” নগরী এখন দর্শনীয় স্থান।
আমার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে সেই মুহুর্তে প্রেরণা জুগিয়েছিল “আক্রোপলিস” আর “আয়ুথায়া।” আমরা আমাদের ৩২ নম্বরের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি সে ভাবেই রেখে দিবো। পৃথিবীর মানুষ জানবে, বঙ্গবন্ধুর উদার মন নিয়ে যে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্থান দিয়েছিল, অধিকার দিয়েছিল এ দেশের মাটিতে বসবাসের এবং সব ধরনের সুযোগের। তারাই সুযোগ বুঝে কী ভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি। তারা ভেবেছে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ধ্বংস করে বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দিবে। কিন্তু ধ্বংসই শেষ কথা নয়।
আমাদের গর্ভের প্রজন্মের মধ্যে ‘‘ মুক্তিযুদ্ধ” দিতে পারলেও তাঁদের উত্তর প্রজন্মের মধ্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ ধারণ করাতে পারিনি। যখন যে ক্ষমতায় এসেছেন তাঁদের মত করে মুক্তিযুদ্ধের, স্বাধীনতার ইতিহাস বলে গেছে। আমাদের প্রত্যয় হোক মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য তুলে আনা। যারা দেশ সৃষ্টি করে তাঁরা ইতিহাস রচনা করে না। ইতিহাস রচিত হয় শত শত বছর পর ইতিহাসের গবেষক দ্বারা। তখন, থাকে না কোনো আবেগ, পক্ষপাতদুষ্টতা । গবেষকদের গবেষণায় রচিত হয় সঠিক ইতিহাস।
শত প্রতিকুলতার মাঝেও আমি বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পরাজিত হতে পারে না। ত্রিশ লক্ষের রক্তস্নাত বাংলাদেশ একদিন বিজয়ের বৈজয়ন্তী মালা পরবেই। এই ওয়েবসাইটটি সেই ইতিহাস সংরক্ষণে সহায়ক হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।