বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত

জাতীয় সঙ্গীত রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃত গান। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় উপলক্ষে ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে এই গান গাওয়া হয় অথবা এর সঙ্গীত বাজানো হয়। জাতীয় সঙ্গীতে একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা ও গৌরবের প্রতিফলন ঘটে। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার একটি নির্দিষ্ট রীতি আছে।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি রচিত হয়েছিলো। ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।১৯০৫ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ”বাউল” নামক গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত আছে।

আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিলো শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগন হরকরা রচিত আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে গানটির সুরের অণুষঙ্গে।[] সরলা দেবী চৌধুরানী ইতিপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে তার শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশী গানের সুরই এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিলো।[]  ১৮৮৯-১৯০১ সময়কালে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির কাজে ভ্রমণ ও বসবাসের সময় বাংলার লোকজ সুরের সঙ্গে তার আত্মীয়তা ঘটে। তারই অভিপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী আন্দোলনের সমসাময়িক গানগুলি, বিশেষত আমার সোনার বাংলা

যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পরে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সম্পূর্ণ আমার সোনার বাংলা গানটি এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই গানের প্রথম দশ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত।

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে
মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥

তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে—
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি॥

ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥

ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে—
দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে—
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি

বিবিসি বাংলার তৈরি সেরা বিশটি বাংলা গানের তালিকায় এই গানটি প্রথম স্থান অধিকার করেছে।

প্রতিবেদন

https://sarabangla.net/post/sb-862087

মোহাম্মদ নাদের হোসেন ভূঁইয়া

March 25, 2024 

জাতীয়তাবাদ প্রকাশের অন্যতম ও সেরা মাধ্যম জাতীয় সংগীত। জাতীয় সঙ্গীত রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃত একটি গান মনে হলেও এটিকে শুধু গান বলে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে। এটি একটি দেশকে গোটা বিশ্বের কাছে উপস্থাপনের অন্যতম মাধ্যম। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে এই সঙ্গীত বাজানো হয়। জাতীয় সঙ্গীতে একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা ও গৌরবের প্রতিফলন ঘটায়। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো জাতীয় সঙ্গীত বাজানো কিংবা গাওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সচেতন আমরা! দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা অনেকেই জাতীয় সংগীত গাওয়ার শুদ্ধ ও সঠিক নিয়ম সম্পর্কে জানি না। কখন, কোথায়, কীভাবে এবং কতটুকু গাইতে বা বাজাতে হবে সে বিষয়ে অনেকেই জানেন না।

জাতীয় সংগীতের ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখি ১৫৬৮ সাল থেকে ১৫৭২ সালের মধ্যে রচিত নেদারল্যান্ডসের জাতীয় সঙ্গীত ভিলহেলমাসকে সবচেয়ে পুরাতন জাতীয় সঙ্গীত ধরা হয়ে থাকে। যদিও ১৯৩২ সালে সরকারী ভাবে স্বীকৃতি পায় এই জাতীয় সঙ্গীত। এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পুরানো জাতীয় সঙ্গীত হল জাপানের জাতীয় সঙ্গীত কিমিগায়ো। এটি রচিত হয়েছিল ৭৯৪ সাল থেকে ১১৮৫ সালের মধ্যে। কবিতা ভিত্তিক এই রচনা ১৮৮০ সালের পরে জাপানের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে দুর্লভ সম্মানের অধিকারী। তিনি একই সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ও ভারতের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা।

২৫ লাইন গানের দশ লাইনকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও সব অনুষ্ঠানে পুরো সংগীত বাজানোর নিয়ম নেই। জাতীয় সংগীত কখন, কোথায়, কীভাবে এবং কতটুকু গাইতে ও বাজাতে হবে সে বিষয়ে ১৯৭৮ সালে ‘জাতীয় সংগীত বিধিমালা- ১৯৭৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই বিধিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জাতীয় দিবস, যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের শুরুতে ও শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ সংগীত বাজাতে হবে। তবে এসব দিবসের প্যারেড অনুষ্ঠানে দুই লাইন শুরুতে বাজানোর নিয়ম রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে সংসদ ভবনে প্রবেশের শুরুতে এবং ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ জাতীয় সংগীত বাজাতে হবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের প্রথম দুই লাইন তাদের আগমন ও প্রস্থানের সময় বাজানোর কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যখন কোনও প্যারেডে সালাম গ্রহণ করেন, তখনো দুই লাইন বাজাতে হয়। রাষ্ট্রপতি যদি কোনও অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন বা কোনও অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অথবা প্রধানমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন তাহলে এসব ক্ষেত্রে তাদের আগমন ও প্রস্থানের সময় দুই লাইন সংগীত বাজানোর নিয়ম রয়েছে। বিদেশীকোনও রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান তার রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সফরে বাংলাদেশে এলে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করার আগে জাতীয় সংগীতের প্রথম দুই লাইন বাজাতে হবে। কোনও বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান, রাজপরিবারের সদস্য, রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা সমমর্যাদার কোনও বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যখন রাষ্ট্রপতির সালাম গ্রহণ করেন, তখনো দুই লাইন বাজবে।

বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী কোনও মিশন যদি কোনও অনুষ্ঠানে সে দেশের জাতীয় সংগীত বাজাতে চায় তবে তার জন্য পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্বানুমোদন লাগবে এবং যদি অনুমোদন দেয়া হয় তবে সেই দেশের জাতীয় সংগীতের আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজাবে। যখন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশী কোনও রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে তার পরিচয়পত্র হস্তান্তরের সময় গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন, তখনো দুই লাইন বাজাতে হয়। সিনেমা প্রদর্শনের আগে ও রেডিও- টেলিভিশনের দিনের অনুষ্ঠানের শেষেও দুই লাইন বাজানো হয়। রাষ্ট্রীয় কোনও অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে শবদাহ বা দাফন করার পরও দুই লাইন ড্রামের তালে বাজানো হয়। বিধিতে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ের দিনের কার্যক্রম জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হবে। অনেক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের চার লাইন গাওয়া হয়, কিন্তু বিষয়টি ভুল।

এতো সব আইনকানুনের পরও দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় সঙ্গীতকে অবমাননা করা হয়েছে। আমরা প্রায় দেখি যত্রতত্র জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হচ্ছে। যেখানে কিনা মানুষ জাতীয় সঙ্গীতের জন্য অপ্রস্তুত। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় আমাদের দেশের খুবই কম সংখ্যক মানুষ জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে সচেতন এবং বেশীর ভাগ মানুষই জাতীয় সঙ্গীত শুদ্ধ ও সুন্দর করে গাইতে পারে না। আবার অনেক অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত পুরো গাওয়া হয় না সময় সল্পতার কারন দেখিয়ে। অথচ বিধিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, যদি কোনও অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় তবে তার সবটুকুই গাইতে হবে। জাতীয় সংগীত শুধু গাইলেই হবে না, তা শুদ্ধ করে গাইতে হবে এবং গাওয়ার সময় এর প্রতি যথাযথ সম্মানও দেখাতে হবে। যখন কোনও অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সংগীত বাজানো হয়, তখন প্যারেড কমান্ডিং অফিসারের অর্ডারের অধীন ব্যতীত অন্যসব অফিসার ও নন- কমিশন্ড অফিসার ও ছাত্র জাতীয় সংগীতের প্রথম নোট থেকে শেষনোট বাজানো পর্যন্ত স্যালুট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। জাতীয় পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। কারও মাথায় টুপি থাকলে খুলে ফেলতে হবে। যদি কেউ এসব নিয়ম ভঙ্গ করে তবে তিনি এক বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে জাতীয় সঙ্গীতের সকল নিয়ম জানা এবং সঠিকভাবে মানা নৈতিক দায়িত্ব। এই জন্য আমাদের সবাইকে জাতীয় সঙ্গীত শুদ্ধ ভাবে শেখা ও চর্চার মনযোগী হতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে যথাযথ আইন মেনে জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে হবে। যত্রতত্র জাতীয় সঙ্গীত বাজানো এবং গাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সর্বোপরি সবাইকে জাতীয় সঙ্গীতের আইনকানুন ও সবকিছু সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান করতে হবে। তাহলেই আগামী দিনের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।

https://www.channelionline.com/%e0%a6%86%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a7%87-%e0%a6%86

আমার সোনার বাংলা কিভাবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হলো

মাহবুব রেজা ২:১২ অপরাহ্ণ ২৮, ফেব্রুয়ারি ২০২০

 কিভাবে, কবে থেকে কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি আমাদের চেতনার সঙ্গে, আমাদের হৃদয়ের অলিন্দে, মস্তিস্কের কোষে কোষে, অস্থিমজ্জায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল? রবীন্দ্রনাথের এই গানটি কিভাবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেল তা নিয়ে গবেষক ও ইতিহাসবিদরা তাদের মতামত ও বিশ্লেষণ ব্যখ্যা করেছেন।

তারা বলছেন, রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মনের কথা, আবেগের কথা, ভালবাসার কথার অনুভব পেতেন। বাঙালিকে কবিগুরু অন্তর দিয়ে ভালবেসেছিলেন সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না

১৯৬৬ সালে ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের ৩ দিনব্যাপি কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি দিয়ে। এই গানটির প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর আলাদা রকমের আবেগ। এই গানটিকেই যে বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করবেন তার ইঙ্গিত তারও আগে থেকে পাওয়া যায়।

গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর গানে এই বঙ্গের প্রতি তার অফুরান ভালোবাসা, মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, দেশপ্রেম, শ্যামল প্রকৃতি, আবেগ, ভালোবাসা, মুক্তির ডাক, অত্যাচার বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-এর সবই খুঁজে পেয়েছিলেন সার্থকভাবে।

সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি অসম্ভব রকমের গান পাগল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি অসম্ভব পছন্দ করতেন গান শুনতে। শিল্প সাহিত্যের প্রতি আলাদা ধরনের পক্ষপাতিত্বও ছিল তার। তার দীর্ঘ কারাবাসের সময় তিনি প্রচুর বই সঙ্গে রাখতেন- কারাগারে বসে লেখালেখির পাশাপাশি গোগ্রাসে বইপুস্তক পড়তেন। বাংলা সাহিত্যের সব নামকরা লেখকদের বই তো পড়তেনই তার বাইরে বিদেশি সাহিত্যের প্রতিও তার দুর্বার আকর্ষণ ছিল। তিনি বন্দী অন্যান্য নেতাদেরও বই পড়া, গান শোনাতে উদ্বুদ্ধ করতেন। বঙ্গবন্ধুর ভীষণ প্রিয় ছিলো কবিগুরুর লেখা।বঙ্গবন্ধুর ওপর যারা গবেষণা করছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন তা। তারা এ প্রসঙ্গে বলছেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর বাণী আর গান শুনে তার নিজস্ব স্বপ্ন পূরণে যোজন যোজন পথ পাড়ি দিয়েছেন। কবিগুরুর গান তাকে উৎসাহ আর প্রেরণা যুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে, দুঃসময়ে কিংবা উত্তাল সময়ের বাঙালি জাতির ভাগ্য নির্ণয়ের কঠিন সিদ্বান্ত গ্রহণে রবীন্দ্রনাথ তার গান দিয়ে, বাণী দিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন পরম বন্ধুর মতো। গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ভেতরে বাঙালি জাতিসত্তার ভাবনার বীজ সফলভাবে প্রোথিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্র গবেষকরা বলছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাংলা ও বাঙালিকে স্বাধীন করার যাবতীয় অনুপ্রেরণা, সাহস এবং শক্তি বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। কবিগুরুর লেখা পরে বঙ্গবন্ধু যেভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তেমনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান আর তার লেখা পড়েও তিনি সমানভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন- একথা বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা, লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন।

প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক অধ্যাপক সনজীদা খাতুন ‘বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় আমার সোনার বাংলা’ শীর্ষক এক লেখায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম ভালবাসার কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি তার লেখায় ষাটের দশকে পাকিস্তানী শাসকদের রবীন্দ্র বিরোধিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখছেন, ‘পঞ্চাশ দশকে একবার আমার খুব ভাল করে মনে আছে- কার্জন হলে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো। আমাকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। আমি খুব বিস্মিত হয়ে গেলাম গান গাইতে। কী গান গাইবো? এমন সময় দেখা গেল সেখানে বঙ্গবন্ধু। তখন তো তাকে কেউ বঙ্গবন্ধু বলে না- শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি লোক দিয়ে আমাকে বলে পাঠালেন আমি যেন ‘সোনার বাংলা’ গানটা গাই- ‘আমার সোনার বাংলা’। আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। এত লম্বা একটা গান। তখন তো আর এটা জাতীয় সঙ্গীত নয়। পুরো গানটা আমি কেমন করে শোনাবো? আমি তখন চেষ্টা করে গীতবিতান সংগ্রহ করে সে গান গেয়েছিলাম কোনমতে। জানি না কতটা শুদ্ধ গেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এইভাবে গান শুনতে চাওয়ার একটা কারণ ছিল। তিনি যে অনুষ্ঠান করছিলেন, সেখানে পাকিস্তানীরাও ছিল। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ কথাটা আমরা কত সুন্দর করে উচ্চারণ করি। এই গানটার ভিতরে যে অনুভূতি সেটা তিনি তাদের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করেছিলেন। এবং আমার তো মনে হয় তখনই তার মনে বোধহয় এটাকে জাতীয় সঙ্গীত করবার কথা মনে এসেছিল। বায়ান্ন সালে আমরা যখন রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চা করি তখন আমরা কিন্তু ঐ বায়ান্নের পরে পরে শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরিতে আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতাম। এবং এইভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীত কিন্তু তখন বেশ চলেছে। আরো পরে কেমন করে যেন একটা অলিখিত বাধা এলো। পাকিস্তান আমলের পরে রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ যখন জাতীয় সঙ্গিত হলো, তার কিছুকাল পরে দেখা গেল- নানা ধরনের চল ছিল তো- সেই সময় গানটা না করে শুধু বাজনা বাজাবার একটা রেয়াজ শুরু হলো। আমার মনে হয় এর মধ্যে সেই পাকিস্তানী মনোভাবটা কাজ করেছে।”

ইতিহাসবিদরা বলছেন, এই গানটি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রথম গাওয়া হয়েছিল। তবে এই গানটি আরও আগে থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন সংগ্রামে বাঙালিকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সে সময়ের সভা সমাবেশে এই গানটি গাওয়া হতো।

গবেষক, ভাষাবিদ এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই গান নিয়ে বলতে গিয়ে গণমাধ্যমে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো ১৯৭১ সালে তো বটেই, এর আরও অনেক আগে থেকেই গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা সমাবেশে গাওয়া হয়েছে। গানটি প্রতিটি বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেছে, প্রেরণাও যুগিয়েছে।

অন্যদিকে দেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমার সোনার বাংলা গানটি ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি গানটি গাইতে বলতেন। তিনি নিজেও অনেক সময় গুনগুন করে গানটি গেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিকথায় এর উল্লেখ আছে।

‘আমার সোনার বাংলা কেমন করে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হলো সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নিজে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রসট-কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি যখন শেষবারের মতো জনসভা করি, যেখানে ১০ লাখ লোক হাজির হয়েছিল আর তখন ‘স্বাধীন বাংলা স্বাধীন বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল, তখন ছেলেরা গানটা গাইতে শুরু করে। আমরা সবাই, ১০ লাখ লোক দাঁড়িয়ে গানটাকে শ্রদ্ধা জানাই। তখনই আমরা আমাদের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীতকে গ্রহণ করে নিই।”

https://www.jugantor.com/exile/375838/%E0%A7%AD%E0%A7%A7-%E0%A6%AA%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%80-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%80%E0%A6%A4-%E0%A6%93-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%9B%E0%A7%81-%E0%A6%95%E0%A6%A5%E0%A6%BE

৭১ পূর্বপরবর্তী জাতীয় সঙ্গীত ভাস্কর্য নিয়ে কিছু কথা

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে 

 ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, ০৩:২২ পিএম  |  অনলাইন

দেশ স্বাধীন হবার পর জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহিদ মিনার গড়ে উঠেছে এবং সেখানে ফুলের মালা দিয়ে, কোরআন থেকে তেলাওয়াত করে দেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদেরকে স্মরণ করি। এটা যে শুধু বাংলাদেশে করা হয় তা নয়, বিশ্বের সর্বত্রই এমনটি হয়ে থাকে। 

তাছাড়া প্রতিটি স্বাধীন দেশে রয়েছে জাতীয় সঙ্গীত। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, ন্যাচার, কালচার ইত্যাদির উপর বিচার বিশ্লেষণ করেই জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করা হয়। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ছিল এমন–

পাকিস্তান জিন্দাবাদ… 
পূরব বাংলার শ্যামলীমায়
পঞ্চনদীর তীরে অরুণিমায় 
ধূসর সিন্ধু মরু সাহারায
ঝাণ্ডা জাগে যে আজাদ…
খাইবার দ্বারে দ্বারে পতাকাবাহী
মেঘনার কূলে যত বীর সিপাহী
প্রাচ্য প্রতীচ্যের মিলন গাহি 
ঝাণ্ডা জাগে যে আজাদ… 
পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

এটি ছিল বিকল্প জাতীয় সঙ্গীত যা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকাকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গাওয়া হতো। গানটি বাংলা ভাষায় লিখিত হয় গোলাম মোস্তফা কর্তৃক ১৯৫৬ সালে। তারানা-ই-পাকিস্তান নামক একটি কবিতা থেকে এটি গৃহীত হয়েছিল। গানটির সূর করেন নাজির আহমেদ।

দেশ স্বাধীন হবার অব্যবহিত পূর্বে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ। পরে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে —“আমার সোনার বাংলা” গানটি গীত হয়। 

আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥    

সন্দেহাতীতভাবেই বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু একটা সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন, যে সোনার বাংলার উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে, ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু সেই সোনার বাংলার স্বপ্নকে তার দেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করেছিলেন। 

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়। বঙ্গমাতা সম্পর্কে এই গাঁথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ১৯০৫ সালে রচিত। বাউল গায়ক গগন হরকরার গান “আমি কোথায় পাব তারে” থেকে এই গানের সূর ও সঙ্গীত উদ্ভূত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সম্পূর্ণ আমার সোনার বাংলা গানটির প্রথম দশ লাইন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত। ইদানীং ফেসবুকের মাধ্যমে দেখছি মাদ্রাসা শিক্ষা-প্রশিক্ষণে সমস্ত শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী মিলিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের সূরকে নকল করে  মুসলমানের জাতীয় সঙ্গীত চর্চা চলছে! 

ইসলাম ধর্মের কোন কিতাবে কে লিখেছে এটা? এবং এরা কোন দেশের মুসলমান? কোথায় পৌঁছে গেছে এই বর্বরেরা! এখনই লাগাম টেনে না ধরলে দেশটা বর্বর যুগে ঠেলে নিয়ে যাবে এরা। হিন্দি সিনেমার গানের সূরে এরা ইসলামী গজল গায়। এখন আবার জাতীয় সঙ্গীতের চর্চা চলছে এভাবে-

“দয়ার আল্লাহ
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার দয়ায়
তোমার মায়ায়
অধম আমি বেঁচে আছি…
 
দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রশাসনের, সঙ্গে আমাদের সবার। মাতৃভূমিকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করা এবং সরকার যদি সেটা জেনে না জানার ভান করে তবে নতুন করে দূর্গ গড়তে হবে।

পাকিস্তানের সময় যে গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সেই গান আর রবীন্দ্রনাথের গানে শুধু পার্থক্য এটাই, রবীন্দ্রনাথ নন মুসলিম। এটাই যদি সমস্যা হয় তবে প্রযুক্তির সমস্ত ডিভাইস (টেলিফোন, টেলিভিশন, ক্যামেরা, কম্পিউটার ইত্যাদি) থেকে শুরু করে সমস্ত পণ্যদ্রব্য, ওষুধ তৈরিতে যেখানে মুসলমানদের কোনো সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই সেগুলোও বয়কট করতে হবে। শুধু সুবিধাবাদী মুসলিম হলে চলবে না।

ভাস্কর্য এবং মূর্তি দুটো ভিন্ন জিনিসকে মিশ্রিত করে সমাজকে দূষিত করা হচ্ছে। যেভাবে ভাস্কর্যে ফুল দেয়া হচ্ছে তাতে মূর্তি পূজার সঙ্গে মিল মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। যখন একটি ভাস্কর্য এত বেশি সম্মানিত যে পূজোর সঙ্গে তুলনীয় সেক্ষেত্রে সঠিকভাবে বিষয়টি ভাবার বিষয় রয়েছে। তবে ভাস্কর্যের কারণে বিষয়টি যদি সত্যি শিরিকে পরিণত হয়ে যায় তাহলে সেটা হবে সেই ভাস্কর্য পরিবারের জন্য দুঃখজনক। 

জাতির পিতা যেহেতু সবার সম্বল সেক্ষেত্রে বিষয়টি সঠিকভাবে ভাবা দরকার। তবে এমন কিছু করা যাবে না যেটা শুধু বাংলাদেশকেই নয়; বিশ্বের দরবারে ইসলাম ধর্মকেও ছোট করে। পবিত্র কোরআনে শত শতবার বলা হয়েছে নামাজ কায়েম কর, হজ্জ কর, জাকাত দাও, মিথ্যা কথা বলো না, দুর্নীতি করো না, ধর্ষণ করো না। এগুলোর উপর সঠিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না, অথচ ভাস্কর্যের উপর এত গুরুত্ব কেন? 

গুরুত্ব যদি দিতেই হয় তবে কোরআন বা হাদিস কর্তৃক সঠিক তথ্য জানতে হবে। ভাস্কর্য নিয়ে কিছু বর্ণনা করা এবং সঠিক যাচাই-বাছাই ছাড়া মূর্তির সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। 

তবে আবু হুরায়রা (রা.) নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ বলেন, ওই লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করার ইচ্ছা করে। তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে তারা সৃজন করুক একটি কণা এবং একটি শস্য কিংবা একটি যব! – সহীহ বুখারী: ৫৯৫৩।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এই প্রতিকৃতি নির্মাতাদের (ভাস্কর, চিত্রকরদের) কিয়ামত দিবসে আজাবে নিক্ষেপ করা হবে এবং তাদের সম্বোধন করে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণসঞ্চার করো। – সহীহ বুখারী: ৭৫৫৭; ৭৫৫৮। 

এই হাদিসগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভাস্কর্য নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন কবীরা গুনাহ। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কুফরীর পর্যায়েও পৌঁছে যায়। ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমি সেই ধর্মে বিশ্বাসী। আমার বাপ-দাদাসহ তাদের চৌদ্দপুরুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। সেই ধর্মকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমারও রয়েছে। সেক্ষেত্রে কোনো রকম ভুলভ্রান্তিকে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়ে মেনে নেয়া অন্যায়।
 

সবাইকে অনুরোধ করবো দয়া করে ক্ষান্ত হোন। নিজ নিজ চরকায় তেল দিন, পরের পিছে না লেগে। আমরা সবাই এখন সব ধর্ম সম্পর্কে কম বেশি সচেতন। আমাদের ভালো-মন্দের দায়ভার আমাদের নিজেদের। যে কারণে আল্লাহপাক কোরআনে জানিয়েছেন হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর পরে আর কোন নবী বা রসূলের আগমন হবে না। কারণ তিনি শেষ নবী এবং রসুল এবং আমরা আমাদের ভালো-মন্দের জন্য দায়ী।
 
দয়া করে অন্যকে হেদায়েত না করে নিজে হেদায়েত হোন এবং অন্যকে নষ্ট এবং ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকুন। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন পরম করুণাময় এবং অত্যন্ত দয়ালু, তিনি আমাদের হেফাজত করবেন। কারণ তিনি রহমানের রাহিম। আমিন।

লেখকরহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com

যে সময়েজাতীয় সংগীতপরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল

 যুগান্তর ডেস্ক 

 ০৭ আগস্ট ২০১৯, ১২:২৯ এএম  |  অনলাইন সংস্করণ

নিজের ভালো লাগা গানের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে জাতীয় সংগীতকে টেনে এনে বিতর্কের মুখে পড়েছেন তরুণ উদীয়মান শিল্পী মাঈনুল আহসান নোবেল।

প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানটিকে তিনি রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীতের চেয়েও বেশি আবেগময় ও বাংলাদেশকে প্রকাশ করে বলে জানিয়েছিলেন। বিষয়টিকে ব্যক্তিগত মন্তব্য বললেও বিতর্ক এড়াতে পারেননি নোবেল।

তার এই মন্তব্যের জেরে দেশব্যাপী তোলপাড় ঘটে। এমনটি ভারতের বাংলা ভাষাভাষিরাও নোবেলের বিরুদ্ধে নানা মন্তব্যে মেতে ওঠে।

তাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে বলে নেটিজেনরা। নোবেলকে নিয়ে যখন এমন বির্তক চলছে তখন অনেকেই আবার বলছেন, জাতীয় সংগীত নিয়ে শুধু নোবেল একটা মন্তব্যই করেছেন।  কিন্তু দেশে বিভিন্ন সময়ে ‘জাতীয় সংগীত’ বদলে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

রাজনৈতিকভাবেই প্রস্তাব আনা হয়েছিল আমার সোনার বাংলা গানটিকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে চালু করার।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা জোর গলায় বলছেন, জাতীয় সংগীত প্রথম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকার।

৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রপতির আসনে বসানো হয় খন্দকার মোশতাক আহমেদকে। ক্ষমতায় বসেই মোশতাক জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে ওই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। কমিটিকে বলা হয় এক মাসের মধ্যে নতুন কোনো সংগীতকে ‘জাতীয় সংগীত’ হিসেবে প্রস্তাব করতে।  

রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিকরা বলছেন, দ্বীন মুহাম্মদ কমিটি এ বিষয়ে তিনটি বৈঠক করে। সে কমিটি দুটো গানের একটিকে  জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেয়। গান দুটো হলো, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা।  কিন্তু ক্যু পাল্টা ক্যুতে ওই প্রস্তাবের হালে আর পানি পড়েনি।  

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে। সে সময় ‘আমার সোনার বাংলা’ কে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়।

সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউর রহমান। ওই সময়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে লেখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন।  আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’

ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন শাহ আজিজুর রহমান।

প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে।

এসময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়।  কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের নিহত হলে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। পাথরে চাপা পড়ে সেই নিদের্শনা।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে।

২০০২ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন।

স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক বিষয়টি অতি গুরত্বপূর্ণ বলে সচিবের কাছে প্রেরণ করেন।

সচিব জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করে। একই বছরের ১৯ আগস্ট প্রস্তাবটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।  

কিন্তু সেই সরকারের আমলেই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। এরপর এ সম্পর্কে আর কোনো তৎপরতা নথিতে পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, জাতীয় সংগীত অপরিবর্তনীয় বলে কোনো আইন নেই। বিভিন্ন দেশে জাতীয় সংগীত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে। ২০০৬ সালে নেপালের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হয়।

নাজিবাদকে উৎসাহিত করে এমন ইঙ্গিত রয়েছে অভিযোগে জার্মানির জাতীয় সংগীতের কয়েকটি লাইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্ণবাদী শাসনের যুগ শেষ হলে ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হয়।   

সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ২০০৪ সালে নতুন একটি সংগীতকে ইরাকের জাতীয় সংগীত হিসেবে সাময়িকভাবে নির্বাচিত করা হয়। তারা এখনও নতুন জাতীয় সংগীত খুঁজছে। আফগান জাতীয় সংগীত এখন পর্যন্ত কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে।

https://www.prothomalo.com/bangladesh/%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%97%E0%A7%80%E0%A6%A4-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E2%80%93%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%83%E0%A6%AD%E0%A7%82%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%A8%E0%A6%BE

মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক

জাতীয় সংগীত মামাতৃভূমির অনন্য বন্দনা

আশীষ-উর-রহমান

আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫, ০৩: ৩৭ 

দৈনিক প্রথম আলো

চিরন্তন এক ভালোবাসার গান আছে বাঙালির। এই গান গর্ভধারিণী মাকে ভালোবাসার, মাতৃভূমিকে ভালোবাসার। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি এই গান গেয়ে। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। এখন বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে গলা ছেড়ে গায় এই ভালোবাসার গান। গানটি আপদে-বিপদে জোগায় সাহস ও প্রেরণা। উৎসবে, উদ্যাপনে বাঙালির গভীরতম হৃদয়াবেগ প্রকাশিত হয় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই গানে। এটি আমাদের জাতীয় সংগীত, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে গাওয়া হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। তবে তার আগে থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে পূর্ব বাংলায় গড়ে ওঠা আন্দোলনে গানটি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। গাওয়া হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে।
এ প্রসঙ্গে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো ১৯৭১ সালে তো বটেই, এর আরও অনেক আগে থেকেই গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে গাওয়া হয়েছে। গানটি উদ্দীপ্ত করেছে, প্রেরণা জুগিয়েছে।
কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি গানটি গাইতে বলতেন। তিনি নিজেও অনেক সময় গুনগুন করে গানটি গেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিকথায় এর উল্লেখ আছে।
বিশ্বকবির এই গানটি কেমন করে আমাদের জাতীয় সংগীত হলো, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত বলেন। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি যখন শেষবারের মতো জনসভা করি, যেখানে ১০ লাখ লোক হাজির হয়েছিল আর “স্বাধীন বাংলা স্বাধীন বাংলা” স্লোগান দিচ্ছিল, তখন ছেলেরা গানটা গাইতে শুরু করে। আমরা সবাই, ১০ লাখ লোক দাঁড়িয়ে গানটাকে শ্রদ্ধা জানাই। তখনই আমরা আমাদের বর্তমান জাতীয় সংগীতকে গ্রহণ করে নিই।’
বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কবিও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেছিলেন বঙ্গভঙ্গের সময়, ১৯০৫ সালে, কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। তবে মূল পাণ্ডুলিপি না পাওয়ায় গানটি রচনার তারিখ পাওয়া যায় না। বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল ওই বছরেরই ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে এক অনুষ্ঠানে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) কবির স্বাক্ষরসহ সঞ্জীবনী পত্রিকায় গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়বার গানটি ছাপা হয় ১৩২২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায়।
জমিদারি দেখভালের কাজে ১৮৮৯-১৯০১ পর্যন্ত বহুবার কবিগুরু কুষ্টিয়া, পাবনা, নওগাঁ এলাকায় আসা-যাওয়া করেছেন, থেকেছেন। তখন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আঙ্গিকের লোকগান, বাউল গানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ঘটে। পরে স্বদেশি আন্দোলনের সময় লেখা অনেক গানে তিনি পূর্ব বাংলার লোকগানের সুর ব্যবহার করেছেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিতে তিনি সুর প্রয়োগ করেছেন কুষ্টিয়ার লোককবি ডাকপিয়ন গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরের অনুষঙ্গে।
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গীতবিতানের স্বদেশ পর্বে অন্তর্ভুক্ত। এর চরণসংখ্যা ২৫। জাতীয় সংগীত হিসেবে কোনো দ্বিরুক্তি ছাড়া ‘আমার সোনার বাংলা’ থেকে ‘আমি নয়ন জলে ভাসি’ পর্যন্ত প্রথম ১০ চরণ গাওয়া হয়। প্রথম চার চরণের যন্ত্রসংগীত বাজানো হয় বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে।
জাতীয় সংগীত সম্পর্কে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এই গানে দেশের বন্দনা, ঋতু ও ভূ-প্রকৃতির বর্ণনা, দেশের প্রতি ভালোবাসার কথা তুলে ধরা হয়েছে। দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই অনন্য গানটিকে আমরা জাতীয় সংগীত হিসেবে পেয়েছি।’
জাতীয় সংগীত কেবল বাঙালির জাতীয় ঐক্যের অন্যতম প্রতীকই নয়, গানটি নিয়ে বিশ্ব রেকর্ডও করেছে বাঙালি। গত বছর মহান স্বাধীনতা দিবসে ঢাকায় জাতীয় প্যারেড ময়দানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ব্যবস্থাপনায় ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ নামের অনুষ্ঠানে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের গাওয়া গানের এই বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে। যান্ত্রিক গণনা হিসেবে সেদিন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন লোক একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গেয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান করে নিয়েছে। শুধু বিশ্ব রেকর্ডই নয়, বাঙালির জীবনে চিরপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে এই গান।

জনমত জরিপ :

২০২৪ সালে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের পুত্র জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন চাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। সেগুলোর কয়েকটি :

Anupam Saikat Santo

4.9.2024

(১)

কোন কিছুই সমালোচনা ও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। প্রশ্নের অতীত ধর্মীয় পবিত্রতা বলে কোন বস্তু দুনিয়ায় বিরাজ করে না, সেখানে জাতীয় সঙ্গীত আর জাতীয় পতাকার মধ্যে এইরকম ধর্মীয় টাইপ পবিত্রতা আরোপ করে সমালোচনা বা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তোলার কোন কারণ দেখি না! জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা একটা দেশ বা রাষ্ট্রের কিছু চিহ্ন মাত্র! যেখানে রাষ্ট্র পরিবর্তনশীল, সেখানে তার এই চিহ্নের কেন পরিবর্তন হতে পারবে না? কোন একটা সময়ে এসে যদি কোন একটা দেশের মানুষের মনে হয়- তার জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকা আর তাকে ধারণ করতে পারছে না, অবশ্যই সেই দেশের জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা বদলে যেতেই পারে। “মহাপবিত্র(!)” সংবিধানের মত আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকাও পরিবর্তন যোগ্য।

(২)

জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা নিয়ে সমালোচনা ও প্রশ্ন আসতেই পারে, এমনকি পরিবর্তনের দাবিও উঠতেই পারে! যারা জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার পরিবর্তন চান না, তারাও পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন। কিন্তু কোন প্রশ্নই তোলা যাবে না, পরিবর্তনের দাবি তোলাই মহাপাপ – এরকম আঁতকে উঠে যখন এসবে পবিত্রতা আরোপ করতে যাবেন, তখন জোর করে চাপিয়ে দেয়া সেই পবিত্রতাকে অসম্মান-অশ্রদ্ধা করার জায়গাই আরো সুগম করবেন!

(৩)

জাতীয় সঙ্গীত ও/ বা জাতীয় পতাকা’র পরিবর্তন যারা চান, তাদেরকে সবার আগে পরিস্কারভাবে পরিবর্তনের যুক্তিটা হাজির করতে হবে। এই যুক্তির জায়গাটি হতে হবে – কেন বর্তমান জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকাটি দিয়ে আর চলছে না, আজকের এই সময়ে এসে এমন কোন নতুন বাস্তবতা আমাদের সামনে হাজির হয়েছে যে, আমাদের নতুন একটি সঙ্গীত ও পতাকার প্রয়োজন হচ্ছে! এই গানটা শুনতে আমার ভালো লাগে না, সুরটায় কোন জোশ আসে না, কিংবা অমুক বা তমুক গানটা বেশি ভালো; অথবা আমাদের পতাকাটা খুব বেশি সিম্পল, এখানে আরো বেশ কিছু সিম্বল ঢুকালে ভালো হয়- ইত্যাদি ইত্যাদি – এগুলো কোন যুক্তিই নয়! আমাদের এখনকার জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীত- উভয়েরই একটা ইতিহাস আছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এই দুটি চিহ্নকে সামনে রেখে, সেই বিষয় মাথায় রেখেই নতুন প্রস্তাবনা আনতে হবে, এবং ৭১ এর বাস্তবতা অতিক্রম করা নতুন বাস্তবতার যুক্তিকেই হাজির করতে হবে!

(৪)

ফলে, আজকেও যখন এরকম দাবি যারা তুলবেন, তাদের মাথায় রাখা উচিৎ – ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সাথে তাদের বক্তব্য ও যুক্তির একটা পার্থক্য স্পষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক আওয়ামী বয়ান থেকে আমাদের যেমন সচেতন থাকা জরুরী, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগ কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধকে কুক্ষীগত করার বিপরীতে ও বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে মুক্তিযদ্ধের বিরোধী শিবিরের প্রচার-প্রোপাগাণ্ডার খপ্পড়ে যাতে না পড়ি- সে ব্যাপারে সচেতন – সচেষ্ট থাকাও জরুরী। একাত্তরের পরাজিত ও পতিত রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামী এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জামায়াত নেতা, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের পুত্র যখন যেভাবে জাতীয় সঙ্গীত পাল্টে দেয়ার আলাপ তুলে, তখন সবার আগে তাদের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা উচিৎ!

(৫)

গোলাম আজম পুত্র আয়নাঘরে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে – ফলে তার প্রতি সহানুভূতি, কিন্তু প্রথম বক্তব্যেই জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর কথা বলা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা, এসবই আসলে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতার রাজনীতি থেকে যে জামায়াত এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি, তারই লক্ষণ! জামায়াত তো জামায়তই! অথচ, ২০১৩ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরে, ৭১ এর ভূমিকার জন্যে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের নতুনভাবে রাজনীতি করার সুযোগ ছিল। কিন্তু না, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তাদের রাজনীতির ভিত্তিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা! আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কালে মুক্তিযুদ্ধের একচেটিয়া দলীয় বয়ানের বিপরীতে জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতার একরকম আবেদন ছিল, কেননা সচেতন না হলে কোনটা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা আর কোনটা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ে আওয়ামী বয়ানের বিরোধিতা – সেটা অনেক সময়ে বুঝা কঠিন। কিন্তু, আজকে যখন আওয়ামী ফ্যাসিবাদও পরাজিত, তখন জামায়াতের মুক্তযুদ্ধ বিরোধিতা খুব সহজেই মূর্ত। ১৯৭১, ১৯৯০ ও ২০২৪ – এর পরাজিত শক্তি যথাক্রমে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগ – তাদের এদেশে রাজনীতি করার মূল শর্তই হচ্ছে ৭১, ৯০, ২৪ এর ভূমিকার জন্যে সবার আগে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া! যতই তারা নিজ অপরাধকে ইনিয়ে বিনিয়ে জাস্টিফাই করতে যাবে, ততই তারা কেবল মানুষের ঘৃণাই অর্জন করবে।

(৬) জাতীয় পতাকা বিষয়ে কিছু পেজে প্রস্তাবনা দেখেছি (জামাতী পেজ কি না নিশ্চিত নই), এই গণঅভ্যুত্থানকে ধারণ করার জন্যে আমাদের লাল-সবুজ পতাকায় চার পাঁচটি তারা ও একটি চাঁদ ঢুকানোর আলাপ দেখেছি। সেখানে সেই তারাগুলোর একেকটার অর্থও করা ছিল (সাম্য, স্বাধীনতা, সার্বভৌমতা, সাহস – এরকম কিছু)। আমি মনে করি, একটা গণঅভ্যুত্থানে যখন রাষ্ট্রের বড় রকম পরিবর্তন ঘটে, তখন জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। ফলে, গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে নতুন পতাকার প্রস্তাবনা আসতেই পারতো, কিন্তু সেটা সেই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য থেকেই হতে হতো! কিন্তু এই গণঅভ্যুত্থানে আমরা উল্টোটা দেখেছি, আমাদের বর্তমান জাতীয় পতাকাটি ছুড়ে ফেলা তো দূরের কথা, আন্দোলনকারী ছাত্র জনতা এই পতাকাটিকে আঁকড়ে ধরেই আন্দোলনে নেমেছে! ফেসবুকেও সবাই লাল-সবুজকে প্রোফাইল বানিয়েছে, ভেতরের লালকে ধারণ করেছে। পুলিশ বাহিনী মাথায় – হাতে পতাকা বাঁধা দেখে দেখেই গুলি চালিয়েছে, গ্রেফতার করেছে! ফলে, ১৯৭১ সালে যেমন এদেশের মানুষ লাল-সবুজ এই পতাকাটিকে নিয়েই যুদ্ধ করেছে, এবারের গণঅভ্যুত্থানেও ছাত্র-জনতা লাল-সবুজ পতাকাটি নিয়েই লড়াই করেছে। পতাকার সিম্বল এখনো প্রাসঙ্গিক, আমাদের সবুজ ফসল ও প্রকৃতির দেশ, আর মাঝখানে শহীদদের রক্ত ও দ্রোহের লাল রঙ। এই সবুজ ও লাল রঙ এখনো প্রাসঙ্গিক, ফলে এই পতাকা পরিবর্তনের কোন কারণই দেখি না। [আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অবশ্য লাল বৃত্তের মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল, স্বাধীন হওয়ার পরে সেই মানচিত্রটি সরানো হয়। কেননা, যেই মানচিত্রের (ভূখণ্ডের) জন্যে আমরা যুদ্ধ করছিলাম, সেটি পেয়ে গিয়েছি, ফলে পতাকায় মানচিত্র থাকার দরকার ছিল না। এছাড়া, মানচিত্র পরিবর্তনশীল, পতাকায় মানচিত্র বসানো কঠিন, তারচেয়েও বড় সমস্যা – দুদিক থেকে মানচিত্র একইরকম দেখায় না।]

(৭)

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা” নিয়ে আপত্তির জায়গাগুলোর প্রধান হচ্ছে – হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ব্রাহ্মধর্ম শুধু না, সনাতনী সমস্ত ধারা উপধারা, বৌদ্ধধর্ম বাদে ভারতীয় অন্যান্য ধর্মগুলোও তাদের কাছে হিন্দুধর্মের সমার্থক)। বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আমাদের উপরে হিন্দুকবি রবি ঠাকুর বর্জনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছিলো বলেই, পাকিস্তানী উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে আমরা রবি ঠাকুরকে আঁকড়ে ধরেছিলাম। রবি ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের ‘বাংলা’ হয়ে উঠেছিলো, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নামক ভূখণ্ডের সমার্থক। আমাদের এরকম একটা গানের দরকার ছিল, যেখানে এই বাংলা ভূখণ্ডকে কেন্দ্রকরে আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জমাট বাঁধে। এই গান আমাদের মাঝে স্ফূরিত হওয়া একটি স্বায়ত্বশাসিত বা স্বাধীন ভূখণ্ডের আকাঙ্ক্ষার অনুগামী ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী হিন্দু কবি রবি ঠাকুরকে যেমন আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলো, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিরও এই গানকে নিয়ে মূল আপত্তি ঐ হিন্দু কবি রবি ঠাকুরই। যদিও এখন রবি ঠাকুরকে নিয়ে বিদ্বেষের ক্ষেত্রে “হিন্দু” পরিচয়কে খুব বেশি প্রকাশ্যে আনে না তারা।

(৮)

রবি ঠাকুরকে নিয়ে আপত্তির ক্ষেত্রে একটা মিথ এদেশে খুব প্রচারিত হয়, রবি ঠাকুর নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। এটি একটি সর্বৈব মিথ্যা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে গড়ের মাঠের সমাবেশে সভাপতিত্ব করা তো দূরের কথা, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে একটি টু শব্দও করেননি। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে কলকাতা থেকে ঢাকায় গিয়ে শিক্ষকতা করার জন্যে তিনি কয়েকজনকে চিঠি লিখেছিলেন। [বিস্তারিত পুরাতন পোস্টে লিখেছিলাম, কমেন্টে লিংক যুক্ত করছি।]

(৯)

“আমার সোনার বাংলা” গানটির বিরোধিতার ক্ষেত্রে আরেকটি সমালোচনা হচ্ছে, এই গানটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে সামনে আনে। পাকিস্তান পর্বে ভাষা আন্দোলন হয়ে ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, স্বাধীন বাংলাদেশে আরো অনেক ভাষাভাষী জাতি সত্ত্বার মানুষের বাস। ফলে, এরকম ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রাখার দরকার নেই। এর জবাবে বলা যেতে পারে, ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেই বঝতে পারবেন, এখানে ‘বাংলা’ কোন ভাষা নয়, বরং একটি ভূখণ্ড। সেই বাংলা নামক ভূখণ্ডকে ভালোবাসার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ফাগুনে আমের বনের ঘ্রাণ, অঘ্রাণের ভরা ক্ষেত, বটের মূলে ও নদীর কূলে বিছানো আঁচল – এসবই আসলে ভূখণ্ডের বর্ণনা, ভাষার না। বাঙালির ভাষা যেমন বাংলা, তেমনি আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের বাংলাকেই আমরা পাচ্ছি ‘আমার সোনার বাংলা’র বাংলায়। তবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষায় লেখা এইই গানটিকে যদি অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে সবগুলো ভাষাতেই অনুবাদ করে গাওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ বলে মনে করি।

(১০)

এই গানের ব্যাপারে সবচেয়ে জোরালো আপত্তি বা প্রশ্ন যেটি উঠে, সেটি হচ্ছে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এই গানটি লিখেছেন, তখন বাংলা বলতে আমাদের এই বাংলাদেশকে বুঝাননি, বরং দুই বাংলা মিলে যে অবিভক্ত বাংলা বা বঙ্গ ছিল তিনি সেটিকে বুঝিয়েছেন। ফলে, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে আমরা যেই বাংলাকে ভালোবাসছি, সেটা শুধু আমাদের বাংলাদেশ নয়, বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গও। এর সাথে আরেকটি যুক্তি করা হয়, এই গানটি রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে – অবিভক্ত বাংলার পক্ষে। ফলে, গানটি বাংলাদেশের চেতনার পরিপন্থী। সেই হিসেবে বাংলাদেশের চেতনা পরিপন্থী কোন গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে না! এখানে, দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব আগে দেই। এটা ঠিক যে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পরে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো, সেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানসিক ও শারীরিকভাবে অংশ নিয়েছিলেন, কলকাতার হিন্দু- মুসলমানদের মিলনের লক্ষে রাখী বন্ধনের আয়োজন করেছিলেন। তবে, এর পেছনে পূর্ববঙ্গের বিরোধিতার চাইতেও বৃটিশদের চক্রান্তে বাংলার মানুষকে বিভক্ত করে দেয়ার বিরোধিতার জায়গাটি প্রধান ছিল, যে জায়গা থেকে পূর্ববঙ্গের অনেক মুসলমান নেতৃত্বও বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন, এমনকি ১৯০৪ সালের প্রাথমিক প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে নবাব সলিমুল্লাহও দাঁড়িয়েছিলেন (পরে তাঁর পরামর্শে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে প্রদেশ করা হয়)। ১৯০৫ সালে রবি ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যতখানি সোচ্চার ছিলেন, পরবর্তীতে একই রকম থাকেননি, বরং আলাদা প্রদেশ হলে যে, পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কিছু উন্নতি হবে, সেটি তিনি উপলব্ধি করে, বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা থেকে সরে এসেছিলেন। ফলে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ দেখিয়ে যেমন বলা যায় না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গের মানুষের বিরুদ্ধে ছিলেন, তেমনি “আমার সোনার বাংলা” গানটিকেও পূর্ববঙ্গের বিরোধী বলার উপায় নেই। হ্যাঁ, এই গানটির বাংলা হচ্ছে, উভয় বাংলা – এখানে যেমন পশ্চিমবঙ্গ ছিল, সমানভাবে পূর্ববঙ্গও ছিল। কবি হৃদয়ে উভয় বঙ্গের মিলনই দেখেছিলেন। আর, বঙ্গভঙ্গ হয়ে দুটো আলাদা প্রদেশ হয়েছিলো মাত্র, তখনও পূর্ববঙ্গ আলাদা কোন দেশ হয়নি, ঐ বঙ্গভঙ্গের পরেও পূর্ববঙ্গের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্ক – যোগাযোগ উবে যায়নি। ফলে, এই গানটিকে বাংলাদেশের চেতনা বিরোধী বলার কোন স্কোপই নেই আসলে।

এবারে, প্রশ্নটির প্রথম অংশে যাওয়া যাক। “আমার সোনার বাংলা”র বাংলা কি পশ্চিমবঙ্গকেও বুঝায়? রবি ঠাকুর যখন লিখেছিলেন, তখন তিনি এই বাংলা বলতে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয়কেই বুঝিয়েছিলেন। এখনো পশ্চিমবঙ্গের কেউ যখন এই গান শুনেন বা গান, তার কাছে বাংলা মানে উভয় বাংলা বা কেবল পশ্চিমবঙ্গ হলেও হতে পারে। কিন্তু, বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই বাংলা হচ্ছে – বাংলাদেশ। কেন বা কিভাবে হলো? ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে, আমাদের ভূখণ্ডের রাষ্ট্রীয় নাম হলো পশ্চিম পাকিস্তান আর ভারতের অংশটুকুর নাম হয় পশ্চিম বঙ্গ বা ইংরেজিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল। সেই সময়ে কিন্তু আমরা আমাদের নাম দাবি করেছিলাম পূর্ব বাংলা। ১৯৪৭ এর আগে এই অঞ্চলকে পূর্ববঙ্গ বা ইস্ট বেঙ্গল বলা হতো (মুখে মুখে কখনো কখনো পূর্ব বাংলাও), কিন্তু ৪৭ এর পরে আমরা নিজেদেরকে কখনো পূর্ববঙ্গ বলিনি, অন্যদিকে ভারতের অংশকেও পশ্চিম বাংলার বদলে পশ্চিম বঙ্গ বলে ডেকেছি। অর্থাৎ, ‘বঙ্গ’কে ভারতকে দিয়ে ‘বাংলা’ নামটি আমরা নিয়েছি। পাকিস্তানের গণ পরিষদেও আমাদের এই ভূখণ্ডকে পূর্ব পাকিস্তান না বলে পূর্ব বাংলা করার দাবিও তুলা হয়েছিলো। সেই পাকিস্তান আমলে যখন স্বাধিকারের আন্দোলনে আমরা “আমার সোনার বাংলা” গানটি গাওয়া শুরু করলাম, তখন আমাদের চোখের সামনে “বাংলা” বলতে উভয়বঙ্গ থাকেনি, হয়ে উঠেছে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার এই ভূখণ্ড। ফলে, রবি ঠাকুরের এই গানটি আমরা যখন নিয়েছি, তখন গানটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে, ভিন্ন অর্থও ধারণ করেছে। যেই অর্থ কবি যখন যে অর্থে লিখেছেন, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই গানটি এদেশের মানুষের মাঝে একটি দেশপ্রেমের ভাব তৈরি করেছিলো, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” – এই বাংলা হচ্ছে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত, তারপরেও এই বাংলা সোনার বাংলা, এবং একে আমরা ভালোবাসি। এই গানটি দেশের জন্যে কি রকম আবেগ তৈরি করেছিলো, তা বুঝতে চাইলে ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া সিনেমায় গানের চিত্রায়নটি দেখতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও মুক্তিবাহিনী গানটি গেয়ে, জাতীয় পতাকা তুলে প্যারেড করতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের জ্বালাময়ী গানের সাথে সাথে এই গানটিও প্রচার করতো! আমাদের দেশের নামটাও রাখা হয় বাংলাদেশ। সবমিলিয়েই, “আমার সোনার বাংলা”র বাংলা আমাদের এই বাংলাদেশ।

(১১)

কেউ কেউ বলছেন, “আমার সোনার বাংলা” গানটির চাইতে দ্বিজেন্দ্রলালের “ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদেরি বসুন্ধরা” – গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বেশী ভালো হতো। কারণ কি? সেখানেও জাতীয়তাবাদ আছে, দেশপ্রেম আছে, এবং গানটি শুনতেও নাকি বেশি ভালো লাগে। হ্যাঁ, যেকোন গানই জাতীয় সঙ্গীত হতে পারতো, তবে সেটা সেই সময়ে মুক্তি সংগ্রামে যারা অংশ নিয়েছিলেন – তাদের কাছে ধন ধান্য পুষ্প ভরা গানটির চাইতেও ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির আবেদন বেশি ছিল বলেই ধন ধান্য পুষ্প ভরা গানটি জাতীয় সঙ্গীর হয়নি। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির আবেদন কেন বেশি ছিল? ঐ আমলের লোকজন ভালো বলতে পারবেন, তবে আমার ধারণা – এই গানে থাকা “বাংলা” শব্দটা এদেশের মানুষের একটা স্বতন্ত্র, স্বাধীন ভূখণ্ডের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পেরেছিলো। এবং, এই গানটি সেই ভূখণ্ডের প্রতি তীব্র ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছে, এর ঋতু বৈচিত্র, এর প্রকৃতি মিলিয়ে এই ভূখণ্ডের প্রতি ভালোবাসা, আর এই নিপীড়িত-অত্যাচারিত ভূখণ্ডের বদনখানি মলিন হলে কষ্ট পাই – এই কথাগুলো ঐ সময়ে যেভাবে আবেগে নাড়া দিতে পারতো, অন্য গানটিতে পারা একটু কঠিনই ছিল। তবে, গানের কথা ও সুরের দিক দিয়ে – যে কারোর যেকোন গান বেশি ভালো লাগতেই পারে, ফলে কারোর কাছে ধন ধান্য পুষ্প ভরা গানটি অধিক পছন্দের হতেই পারে। যেমনঃ আমার কাছে ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটি জাতীয়তাবাদী গান হিসেবে প্রচণ্ড জাত্যাভিমানী একটা গান! নিজ জাতি – নিজ দেশের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার কোন কার্যকারিতা আসলে নেই, এখান থেকে জাতিগত অহম আর অন্য জাতির প্রতি বিদ্বেষের সৃষ্টি হতে পারে। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, এর আকাশ, নদী, ক্ষেত, বটমূল – আমার ভালো লাগে, এগুলো অন্য কোথাও পাওয়া যাবে কি না, বা সবার সেরা কি না, সেটা আমার জানার দরকার নেই। আজকে ধন, ধান আর ফুলে ভরা বলে যদি দেশকে ভালোবাসি, কাল যখন ধন, ধান আর ফুলের অভাব হবে, তখন কি দেশপ্রেম উবে যাবে? এসব মিলেই এই গানটি শুনতে ও গাইতে ভালো লাগলেও, দেশাত্মবোধক গানের পছন্দের তালিকায় এটাকে অনেক পেছনেই রাখি।

(১২)

কারো কারো মতে, “আমার সোনার বাংলা” গানটির সুরটা খুব ঝিমানো টাইপের। জাতীয় সঙ্গীতের সুর হতে হয় এমন, যেটা শুনলে শরীরে একরকম জোশ আসে। হ্যাঁ, অনেক দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সুরই কিছুটা বিদ্রোহী ধরণের, মিলিটারির কুচ কাওয়াজের সাথে যায় এমন। সেই হিসেবে করলে, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত একটু আলাদা, এর সুর সেরকম নয়। এখানে, বুঝা দরকার – আমাদের দুটো সঙ্গীত আছে – একটি জাতীয় সঙ্গীত ও অন্যটি রণ সঙ্গীত। অর্থাৎ, জোশ আসা, কুচকাওয়াজের সাথে যায় – এরকম সঙ্গীত হচ্ছে আমাদের রণ সঙ্গীত, কাজী নজরুল ইসলামের “চল চল চল, ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণী তল, অরুণ প্রাতের তরুণ দল, চল রে চল রে চল”। এদিক দিয়েও আমাদের জাতীয় সঙ্গীত অনন্য, সেটি কেবল একটি জাতীয়তাবোধ তৈরি করে, খুব ধীর-স্থির ভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশের জন্যে কিছু করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিক্ষুব্ধ, উথাল-পাতাল, অনিশ্চিত সময়ে এই গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের মনকে শান্ত করতো। তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদের “মুক্তির গান” সিনেমাটিতেও আমরা এই গানের চিত্রায়ন দেখি, সেখানে শান্ত নদীতে নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধারা (গানের দলটিকে আমি মুক্তিযোদ্ধাই বলি) যাচ্ছে। যুদ্ধে যাওয়ার আগে বা যুদ্ধ করে ফেরার সময়টায় আসলে এরকম শান্ত-সমাহিত সুরের চাইতে কথিত জোশ ওয়ালা সুর মানানসই হতো? আমার মনে হয় না! ফলে, জাতীয় সঙ্গীত মাত্রই যে অনেক জোশ আনা সুর হতে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা আমি দেখি না। জোশের অভাব যাদের, তাদের জন্যে আমাদের রণ সঙ্গীত তো আছেই।

আর, সুরের দিক দিয়েও এই গানটি আমাদের দেশের একদম মাটি ঘেঁষা সুর। আমাদের বাউল সুরে গান। এই সুরের কারণেই বরং গানটি আরো বেশি করে আমাদের দেশকে ধারণ করতে পারে বলে মনে হয়!

(১৩)

সবচেয়ে বড় কথা, এই গানের প্রাসঙ্গিকতা কি বর্তমানে হারিয়ে গিয়েছে? বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদকে ক্ষতিকর মনে করেন, আন্তর্জাতিকতাবাদের জয়গান গান, কিন্তু একটা স্বাধীন – সার্বভৌম পুঁজিবাদী রাষ্ট্র টিকে থাকে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে। এই সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের খপ্পর থেকে মুক্ত রাখতে, কিংবা দেশের অভ্যন্তরে স্বৈরাচার-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের দাবিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে জাতীয়তাবাদ। সেখান থেকেই জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা সহ রাষ্ট্রীয় এই চিহ্নগুলো জাতীয়তাবাদেরই অনুষঙ্গ হয়, বা হতে হয়। আমাদের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীত কি জনগণের মাঝে জাতীয়তাবোধ জাগাতে পারে না? গভীর উপলব্ধি নিয়ে শুনতে পারলে, আমার ধারণা পারে। এই যে দেশের প্রতি এই তীব্র ভালোবাসা, সেই দেশমাতৃকার বদনখানি মলিন হলে, আমরা কিভাবে স্থির থাকতে পারি? বলেন, এই গানটি কি আমাদেরকে দেশের যেকোন সংকটে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে পারছে না?

Anjan Kumar Das

5.9.2024

জাতীয় সংগীত নিয়ে একটি বিতর্ক উসকে দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে হবে। নানারকম যুক্তি প্রদর্শন করা হচ্ছে, প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কেউ বলছেন জাতীয় সংগীতে বাংলাদেশ শব্দটি নাই তাই এটা পরিবর্তন করতে হবে, কেউ বলছেন এটির রচয়িতা ভারতীয় বা হিন্দু তাই এটা পরিবর্তন করতে হবে। কেউ বলছেন এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় তাই এটা পরিবর্তন করতে হবে। কেউ আবার প্রশ্ন তুলছেন এখানে যে মায়ের কথা বলা হয়েছে সেটা কোন মা?

এই প্রেক্ষিতে প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধানে এই লেখা।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীত একটু ঘেঁটে দেখলাম। দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর অনেক দেশের জাতীয় সংগীতে দেশের নাম নাই। এই তালিকায় আছে মালয়েশিয়া, ইরান, সৌদি আরব, ইউএসএ, ইউকেসহ আরো অনেক দেশের নাম। অতএব নাম না থাকাটা কোন ব্যতিক্রম কিছু নয়। আমাদের জাতীয় সংগীতে ‘বাংলা’ শব্দটি অন্তত আছে। যে দেশগুলোর উল্লেখ উপরে করলাম সেখানে নামের গন্ধও নাই। আমি পৃথিবীর সব দেশের খোঁজ নিতে পারিনি। খুঁজলে এই তালিকা দীর্ঘ হবে সন্দেহ নাই। অতএব এই যুক্তি আসলে ধোপে টেকে না।

আবার রবীন্দ্রনাথ যে সময় মারা যান সে সময় আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জন্মই হয়নি। তাঁর রচিত গান যে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের জাতীয় সংগীত হবে এটা তিনি জীবিত অবস্থায় জানতেন না। তারপরও রবীন্দ্রনাথ কি ধরনের জাতীয়তায় বিশ্বাস করতেন সে আলাপ আমাদের সাহায্য করতে পারে। তার আগে জাতীয় সংগীত কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতটি জানা গেলে ভালো হতো। ঘটনাচক্রে এটা বুঝার মতো দৃষ্টান্ত আমাদের হাতে আছে।

১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের পক্ষ হতে রবীন্দ্রনাথের কাছে মতামত চাওয়া হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ে ‘বন্দেমাতরম’ গানটি ভবিষ্যতে ভারতের জাতীয় সংগীত করা যায় কি না। জবাবে রবীন্দ্রনাথ- যায় না মর্মে- মত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এতে ভারতের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলমানদের আঘাত করা হবে এবং তাঁদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করা হবে।

আবার তারও আগে ১৮৯৬ সালে কলকাতায় সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য এই ‘বন্দেমাতরম’ কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে অনুরোধ করা হলে রবীন্দ্রনাথ শুধু প্রথম দুই স্তবকের অনুবাদ করে দিয়েছিলেন যেখানে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা আছে। কিন্তু বাকিটা করতে অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন কবিতার বাকি অংশটি ওনার মতের সাথে, বিশ্বাসের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই ওটার অনুবাদ তিনি করবেন না।

অতএব বলা যায় রবীন্দ্রনাথ জাতীয় সংগীত বিষয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাব পোষণ করতেন। এখানে অন্য একটি তথ্যও প্রাসঙ্গিক হবে। সারাজীবনে রবীন্দ্রনাথ দেশাত্মবোধক গান লিখেছেন মাত্র ৪৮ টি। ১৯১২/১৩ সালের পরে তিনি আর কোনো দেশাত্মবোধক গান রচনা করেননি। কারণ ততদিনে তিনি জাতীয়তাবাদের উপর আস্থা হারিয়েছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। তবে ওটা স্যামুয়েল হাণ্টিংটনের Clash of civilizations এ যেটা বলা হয়েছে ওটা নয়। অনেকেই এদেশে এখন হাণ্টিংটনের লাইনে কথাবার্তাও বলছেন।

যাইহোক, ১৯১২ সালের পর হতে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ বিষয়ে যত বক্তব্য রেখেছেন সেসব তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ নামের বইটিতে সংকলিত আছে। বইটি পড়লে বুঝা যায় জীবনের এই পর্যায়ে এসে যদিও জাতীয়তাবাদকে তিনি অপ্রয়োজনীয় বলেনি কিন্তু এটাকে যথেষ্ট মনে করতেন না। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন জাতীয়তাবাদ অনেক সময় অন্য জাতীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উৎপাদন করে এবং হানাহানির জন্ম দেয়।

এবার আসুন যিনি জাতীয়তাবাদের উপর আস্থা হারিয়েছিলেন তাঁর গান বা একজন ভারতীয় হিন্দু কবির গান আমাদের জাতীয় সংগীত হতে পারে কি না এই তর্কে।

অমর্ত্য সেনকে ২০০৮ সালের ১৪ অক্টোবর অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তার কিছুদিন আগে ২০০৮ সালের ১৫ ও ২০ আগষ্ট তিনি দিল্লীতে ইউনেস্কো বক্তৃতা দিয়েছেন ‘সহস্রাব্দে পৃথিবী’ শিরোনামে। ঐ বক্তব্যের এক জায়গায় তিনি বলেছেন — ❝কোনো কোনো জিনিস সুনির্দিষ্ট ভাবে কোনও দেশ বা সংস্কৃতির থেকে জন্ম নিতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে যদি ধরে নেওয়া হয় যে, অন্যত্র তার ব্যবহারের কারণে ব্যবহারকারী দেশ বা সংস্কৃতির অবমাননা হল, সেটা হবে এক ভিত্তিহীন ধারণা। ❞

ধরেন আইনস্টাইনের কথা। তিনি ইহুদি ছিলেন। কিন্তু এটা দিয়ে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা কিংবা তাঁকে অবমূল্যায়ন করা যায় না। একই কথা খাটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ফিলিপ জে হার্টগের বেলায়। তিনিও ইহুদি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি প্রথম শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অপরিসীম পরিশ্রম এবং অবদানের কথা সবাই স্বীকার করেন। এসব আবার ইজরায়েলের বর্বরতাকে জাস্টিফাই করে না।

একইভাবে সভ্যতায় ইসলামের অবদানের বিষয়ও উঠে এসেছে অমর্ত্য সেনের উপরে উল্লিখিত বক্তৃতায়। অমর্ত্য সেন স্পষ্ট করে লিখেছেন —

❝কোনো ধারণা বা বস্তু বা চর্চার উৎসের তেমন বিরাট কোনও তাৎপর্য না-ও থাকতে পারে। যেটা যাচাই করা জরুরি তা হল, সেই ধারণা বা বস্তু বা চর্চার অবদান কী, আর তার প্রভাবে অন্যদের দমিত হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি। ❞

অতএব জাতীয় সংগীত একজন হিন্দু এবং ভারতীয় বাঙালি লিখলেই সেটা বাতিল হয়ে যাওয়ার ভিত্তি তৈরি হয় না। বরং গর্ব করতে পারেন এটা একজন নোবেল বিজয়ীর রচিত।

এখন দেখা যাক আমাদের জাতীয় সংগীত সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের সাথে সংগতিপূর্ণ কিনা বা এক্ষেত্রে কোনো অসংগতি আছে কিনা। এটি যাচাইয়ের জন্য আকবর আলি খান ১০টি মুসলমান দেশের জাতীয় সংগীতের সাথে আমাদের জাতীয় সংগীতের একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তাঁর ❝দূর্ভাবনা ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে❞ বইতে। তালিকার দেশগুলো হলো—সৌদি আরব,মিশর, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান, আলজেরিয়া, ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আগ্রহীরা বইটি পড়ে নিবেন। এই লেখার অনেক তথ্য বইটিতে আছে। আমি শুধু তাঁর মূল্যায়নটি বলি। তিনি বলেছেন বক্তব্যের দিক হতে আমাদের জাতীয় সংগীত অন্যান্য দেশের সাথে তুলনীয়। তবে দুটি বিষয়ে শ্রেয়। এক- এটি একজন বিখ্যাত কবির লেখা। এখানে যে ধরনের কাব্যিক বর্ণনা আছে তালিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেটা অনুপস্থিত। দুই- বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর ও কথা একই ব্যক্তির। ফলে এখানে ভাব সুরের যে মিলন হয়েছে এটা পৃথিবীর খুব কম দেশেই দেখা যায়।

যাইহোক এবার জাতীয় সংগীত নিয়ে অন্য একটি আপত্তি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপত্তি তোলা হয় ‘মা’ শব্দটি নিয়ে। হিন্দুরা যেহেতু দেবী এবং মানবী দুই অর্থেই মা শব্দটি ব্যাবহার করেন তাই প্রশ্ন ওঠে আমার সোনার বাংলায় ‘মা’ শব্দটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? জাতীয় সংগীত ভালো মতো পড়লে এখানে অস্পষ্টতা থাকার কথা নয়। এখানে দেশকেই মায়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে মানবী অর্থে। আর তাছাড়া দেবী অর্থ থাকায় ‘বন্দেমাতরম’ কে যে রবীন্দ্রনাথ ভারতের জাতীয় সংগীত হওয়ার অনুপযুক্ত বলেছেন সে প্রসঙ্গে তো আগেই আলাপ করেছি।

মাতৃভূমিকে মায়ের সাথে তুলনা রবীন্দ্রনাথ একা করেননি। নজরুলের ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি নিশ্চয়ই পড়েছেন। এই লাইনগুলো আবার পড়েন—

❝অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ

কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।❞

নজরুলের আরো গান পাবেন। আরেকটিতে আছে—

❝ জননী মোর জন্মভূমি, তোমার পায়ে নোয়াই মাথা

স্বর্গাদপি গরীয়সী স্বদেশ আমার ভারত-মাতা।❞

বিষয়টি আরো ঘোরালো করার জন্য কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন মা শব্দটি দেশ অর্থে হলেও বাংলাদেশ অর্থে নয়। পুরো বাংলা অর্থে। হ্যাঁ, তখন তো বাংলাদেশই ছিলো না। বাংলাদেশ অর্থে হবে কিভাবে? কিন্তু তখনকার বাংলার বৃহত্তর অংশ নিয়েই বাংলাদেশ। আয়তন অর্থেও, জনসংখ্যা অর্থেও। তাহলে এটা আমাদের দাবি নয় কেন?

আর কবিদের কবিতা তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকে না। এটা গণমানুষের সম্পত্তি হয়ে যায়। কোনো ধারণা, বস্তু বা চর্চার উৎসের তাৎপর্য সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে অর্মত্য সেনের একটি বক্তব্য আগেই উদ্ধৃত করেছি। আশাকরি আপনারা ভুলেননি।

এবার অন্য একটি উদাহরণ দিই। পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা আল্লামা ইকবালকে সকলে চিনেন। ১৯০৪ সালের আগষ্ট মাসে তিনি ❝ সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা❞ তারানাটি রচনা করেন। ইন্টারনেট সার্চ দিয়ে গানটির ইংরেজি পড়ে দেখবেন। কি অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক একটি গান। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে মুসলিম লীগের সম্মেলনে সভাপতির ভাষনে তিনি ভারত বিভক্তির দাবি তোলেন। অর্থাৎ ২৬ বছর আগে যে বিশ্বাস এবং চেতনাতে তাঁর আস্থা ছিলো সময়ে পরিপ্রেক্ষিতে এতে ফটাল ধরে।

কিন্তু গানটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। এখনো গানটির ৪টি স্তবক ভারতীয় সেনাবাহিনীর রণসংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। এটাই বাস্তবতা। যে লোক পরে হিন্দুস্তানে বিশ্বাসই রাখেনি তাঁর গান কেন ভারতের রণসংগীত হবে এ প্রশ্ন অবান্তর। বিজেপি যে অদুর ভবিষৎ এই প্রশ্ন তুলবে না এই ভরসা আমার নাই। কিন্তু তুললেও সেটা ন্যায্য বলা যাবে না।

আবার পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা হাফিজ জলন্ধরি অবিভক্ত ভারতে শ্রীকৃষ্ণের প্রশংসা করে ‘কৃষ্ণ কানহাইয়া’ গানটি লিখেছিলেন। এই জন্য তিনি ❝পাক সার জমিন শাদ বাদ❞ লিখার অযোগ্য হয়ে যান না। এই ক্ষেত্রে যে লোক হিন্দু অবতার কৃষ্ণের প্রশংসা করে গান লিখতে পারেন তাঁর পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত রচনার অধিকার নাই টাইপের যুক্তি আসলে পাকিস্তানিরাও মানে না। বুঝতেই পারছেন।

প্রকৃতপক্ষে একবিংশ শতাব্দীতে এসে রবীন্দ্রনাথ, আল্লামা ইকবাল, শেক্সপিয়ার, কাহলিল জিবরানদের মতো কবিদের কোন একটি দেশের বা গোত্রের কবি হিসেবে ব্রেকেটবন্ধী করাটা সংকীর্ণতা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় পাকিস্তানের জাতির পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্না জগন নাথ আজাদ নামে একজন হিন্দু কবিকে দিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত রচনার একটি উদ্যোগ নিয়ে পরে সরে আসেন। বিখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের সাড়া জাগানো আত্মজীবনী Beyond the Lines এর একেবারে প্রথম পৃষ্ঠায় তথ্যটি আছে। এটা বেরিয়েছিল ২০১২ সালে দিল্লির রলি বুকস পাবলিকেশন্স হতে। এবং ২০১২ সালেই এটার বাংলাদেশ এডিশান বাজারে আনে ডেইলি স্টার।

যাইহোক জাতীয় সংগীত, শহীদ সংখ্যা এসব বিষয়ে নানা রকম বক্তব্য হাজির করে যেটা প্রকাশ্যে বলা হয় ওটাই আসল বক্তব্য না। এগুলো হলো কৌশল। ট্রুথ মেকিং এর কৌশল। দেশে প্রতিক্রিয়াশীলরা এসব করেন। কেন ট্রুথ মেকিং বলছি বা ট্রুথ মেইকিং আসলে কি তা নিয়ে একদিন বিস্তারিত আলাপের ইচ্ছে থাকল।

এখন অন্য একটি বিষয় শেয়ার করি। আপাতত অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। মনে হতে পারে ধান বানতে বসে শিবের গীত গাইছি। কিন্তু একটু ভাবলে গভীর মিল খুঁজে পাবেন।

ভারতের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের ❝দেশদ্রোহী কে?❞ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে আছে। আপনারা জানেন ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার এঁরা আবার বিজেপির চক্ষুশুল। যাইহোক আমি যে তথ্য দিচ্ছি ওটা ইরফান হাবিবের উল্লেখিত প্রবন্ধটি হতে নেওয়া।

ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসকে তো অনেকে চিনেন। এরা ১৯৪৭ এর আগে এবং পরেও অনেকদিন ভারতের পতাকা, সংবিধান এসব মানে না বলে প্রকাশ্যে প্রচার চালাতো। ১৯৪৮ এ এদের একজন প্রাক্তন সদস্য নথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার পর এরা নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সংক্রান্ত আলোচনায় সর্দার প্যাটেল শর্ত দেন সংবিধান এবং জাতীয় পতাকাকে মানে বলে স্বীকার করতে হবে। আরএসএস প্রথমে এই শর্ত অস্বীকার করে। তখন সরকার জানালো তাহলে নিষেধাজ্ঞা উঠবে না। তখন বাধ্য হয়ে মুচলেকা দিয়ে বলেছিলো সংবিধান মানবে এবং জাতীয় পতাকাও মানবে। ইরফান হাবিব এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন—

❝আসলে সবই ধোঁকাবাজি ছিলো। মানতো না কোনটাই। চিরকাল ওরা গেরুয়া পাতাকাকে স্যালুট করেছে। তারা এখন অন্যদের দেশবিরোধী বলছে।❞

জাতীয় পাতাকার সম্মান রক্ষার নামে এরা ভারতব্যাপী কি কি করেছে অনেকেই জানেন। গোলাম আজমের ছেলে যখন জাতীয় সংগীত নিয়ে দরদ দেখায় কেন যেন ইরফান হাবিবের কথা মনে পড়ে। সন্দেহটা জেগে উঠে।

তবে আয়নাঘর সমাধান নয়। মুক্ত আলোচনা হলে দেশের মানুষ ঠিকই বুঝবে কার কি উদ্দেশ্য। দেশের মানুষকে বেকুব ভাবার কোনো কারণ নাই।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত : পরিবর্তনের ধড়িবাজি

আখতারুজ্জামান আজাদ

‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রচনাকাল হিশেবে ১৯০৫ সালই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তবে, গানটি যে ১৯০৫ সালেই রচিত হয়েছে, এ-ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ নেই। কেননা গানটির পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই, রচনাকালও আনুমানিক। এই গান ১৯০৫-এর কিছুকাল আগেও রচিত হয়ে থাকতে পারে। ব্রিটিশ ভারতে প্রথম বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল ঐ বছরের ১৬ অক্টোবর। আর কোলকাতা টাউন হলে এই গান গাওয়া হয়েছিল আগস্টের ৭ বা ২৫ তারিখে। একেক জায়গায় একেক তারিখ পাওয়া যায়। গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষিতেই লিখেছিলেন, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে, কোলকাতা টাউন হলে গানটি প্রথমবার গাওয়ার নেপথ্য উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গভঙ্গ-রদ— এটুকু সর্বজনস্বীকৃত। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিলেন না। তিনি অখণ্ড বঙ্গ চেয়েছিলেন। কোথাও-কোথাও তথ্য দেখা যায়— বঙ্গভঙ্গের ফলে যে দুই বঙ্গ আলাদা হয়েছিল, পিছিয়ে-পড়া মুসলমানজনগোষ্ঠী এতে চাকরিবাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে উপকৃত হচ্ছিল। আবার, এও দেখা যায় যে, বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গ আলাদা কোনো রাজ্য হয়নি, বরং আসামকেও এর সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের একাংশ বিশ্বাস করে— বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা যারা করেছিলেন, তারা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের উন্নতি বরদাশত করতে পারেননি। আবার বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন যারা, তাদের কারো-কারো ভাষ্য হলো— বঙ্গভঙ্গের ফলে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশে বাঙালিরা অনেকটা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছিল। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতাকারীরা এটিকে মেনে নিতে পারেননি। তারা এটিকে ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ ষড়যন্ত্র হিশেবেও আখ্যায়িত করেন। এই বিরোধিতার পেছনে আরো অনেক কারণ জড়িত, যা এই লেখার আলোচ্য বিষয়বস্তু না। মোদ্দা কথা— বঙ্গভঙ্গের সাথে বা বঙ্গভঙ্গ রদের সাথে ধর্মের চেয়ে রাজনীতি ও অর্থনীতিই বেশি জড়িত। রদের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ফলে, নিঃসন্দেহে বলা যায়— ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। তবে, গানটিকে আচমকা আসমানি আঘাতের মতো রাতারাতি এ-দেশের জাতীয় সংগীত বানানো হয়নি। বরং ইতিহাসের বহু স্তর ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে এই গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়ে যাওয়ার পরপরই সেই গানের আবেদন বা মেয়াদকাল শেষ হয়ে যায় না। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেছে— এর মানে এই না যে, ১৯১১ সালেই ছয়বছর-বয়স্ক ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের অকালমৃত্যু হয়ে গেছে। ‘আমার সোনার বাংলা’ বেঁচে আছে অন্তত একশো উনিশ বছর ধরে।

এ-কথা নিশ্চয়ই সবার জানা— দেশবিভাগের পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী একমাত্র উর্দুকে সমগ্র দেশের রাষ্ট্রভাষা হিশেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল এবং ১৯৫২ সালে এর প্রেক্ষিতে ভাষা-আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুর বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিল। তখনকার বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরা পূর্ব পাকিস্তানকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ সম্বোধন না-করে ‘পূর্ব বাংলা’ সম্বোধন করতেন। অবিভক্ত পাকিস্তানের রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন, সরকারি গণমাধ্যমে কোনো ধরনের রবীন্দ্রসংগীত বাজানো তখন নিষিদ্ধ ছিল, ব্যক্তিপর্যায়েও রবীন্দ্রচর্চা ছিল দুরূহ। কাজী নজরুল ইসলামের সেসব গানই তখন বাজানো হতো, যেগুলো ‘হিন্দুয়ানি না’ কিংবা ‘কম হিন্দুয়ানি’। কথিত ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ সরিয়ে, যেমন ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’-কে ‘সজীব করিব গোরস্তান’ বানিয়ে, তৎকালে নজরুলের গানের মুসলমানি করা হয়েছে। বাংলা বাক্য আরবি-ফারসি কিংবা উর্দু হরফে লেখার প্রস্তাব দেওয়ার মতো অকল্পনীয় ধৃষ্টতাও ঐ আমলে দেখানো হয়েছে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন আইউব খান সরকার রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বলেছিলেন— ‘রবীন্দ্রসংগীত আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়।’

১৯৬১ সাল ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদযাপন তখন অত সহজ কম্ম ছিল না। বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীদের নেতৃত্বে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সেই পরিস্থিতিতেও রবীন্দ্রশতবর্ষ উদযাপন করেছিলেন এবং এই অপরাধে শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করে রাখা অত্যন্ত জরুরি যে, মুক্তিযুদ্ধকালে হত্যা করে গোবিন্দ চন্দ্র ও মোফাজ্জল হায়দারকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাদের সেই অপরাধের শাস্তিও দিয়েছিল। ১৯৬১ সালের রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্‌যাপন হয়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালে তাদের মৃত্যুর কারণ। অর্থাৎ সামরিক শাসকদের রবীন্দ্রভীতি আর বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের রবীন্দ্রপ্রীতি কোনো মামুলি ব্যাপার বা ছেলেখেলা ছিল না, ছিল এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের সূচনাপর্ব। এই রবীন্দ্রনাথের গানই প্রাক-একাত্তরকালে স্বাধীনতাকামী জনতাকে উদ্বেলিত করেছে, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উজ্জীবিত করেছে, একাত্তর-পরবর্তীকালে যুগিয়েছে স্বৈরাচারপতনের মন্ত্রণা। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানিদের উর্দু জাতীয়তাবাদের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার বাসিন্দাদের পালটাপালটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম নিয়ামক হিশেবে কাজ করেছেন ১৯৪১ সালে মারা যাওয়া রবীন্দ্রনাথ। জীবিত না-থেকেও রবীন্দ্রনাথ পূর্ব পাকিস্তানে জীবিত ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রভাবক হিশেবে।

একষট্টি-পরবর্তীকালে সন্‌জীদা খাতুনদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট, যার সদস্য ছিলেন মূলত একষট্টিতে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্‌যাপনের আয়োজকরা। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালের পহেলা বৈশাখ ভোরে রমনা উদ্যানের অশ্বত্থগাছের পাদদেশে ছায়ানটের জনা বিশেক শিল্পী বসে পড়েছিলেন সেরেফ গান গাওয়ার জন্য। মূলত রবীন্দ্রনাথের গানই ছিল সেই সংগীতায়োজনের উপজীব্য। ও রকম গুমোট পরিস্থিতিতে বন্দুকের নলের মুখে রবীন্দ্রনাথকে উপজীব্য করে প্রকাশ্যে গান গাইতে বসা, উপর্যুপরি বাংলা গান গাইতে থাকা, উর্দু-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই সহজ কোনো কাজ ছিল না। তখন সেরেফ এ-রকম একটা সংগীতায়োজনই ছিল বিশাল রাজনৈতিক প্রতিবাদ। সম্ভবত ১৯৬৭ সালেই পহেলা বৈশাখকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহারের সূত্রপাত হয় এবং এই হাতিয়ার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের বিপক্ষে, এই হাতিয়ার ছিল বাংলার স্বাধিকার আদায়ের পক্ষে, এই হাতিয়ার ছিল বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক-সামরিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। একাত্তরের যুদ্ধ নিছক সামরিক ছিল না। যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছতে, অর্থাৎ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে যে সাংস্কৃতিক ধাপগুলো ছিল; এদের মধ্যে এই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনও ছিল অন্যতম। পূর্ব পাকিস্তানে কৌশলগত পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের সাথে জড়িত প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ।

শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে ‘আমার সোনার বাংলা’ আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীত হয় ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি। কিন্তু তা শেখ মুজিবুর রহমানের একক পছন্দে হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হিশেবে গাওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রেও এই গানকে জাতীয় সংগীত হিশেবেই গাওয়া হতো। আরেকটু পিছিয়ে গেলে, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রামপরিষদের সভায়ও ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত হিশেবে। ২৩ মার্চ পাকিস্তানদিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান থাকলেও ঢাকা টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা পাকিস্তানদিবসের কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করতে দেননি। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের বদলে এদিন প্রচারিত হয় ‘আমার সোনার বাংলা’। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার বদলে পর্দায় ভেসে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন এই গান। এর পর ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে গ্রহণের ঘোষণা আসে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রেও ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৬ সালে ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামি লিগের তিনদিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনেরও উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সাংসদদের সম্মানে শেখ মুজিব কার্জন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান পরিবেশিত হয়েছিল। ঐ অনুষ্ঠানে সন্‌জীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন শেখ মুজিব।

ঢাকা জেলা ছাত্রলিগের সাবেক সভাপতি ‘আবদুল আজিজ বাগমার’ জন্ম দিয়েছিলেন ‘অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার’। সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’। আরো সংক্ষেপ করে লেখা হতো ‘অপু’। তারা একটি সরকারকাঠামোও ঠিক করেছিলেন। আবদুল আজিজ বাগমাররাও ‘অপু-৩’ ইশতেহারে নতুন দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’ এবং জাতীয় সংগীত হিশেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ প্রস্তাব করেছিলেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হুট করে ১৯৭১ সালে এসে পড়েনি। এর বহু বছর আগে থেকেই স্বাধীনতার কথা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছিল, সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা হচ্ছিল এবং নতুন দেশের জাতীয় সংগীতও ভেবে রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেমন আচমকা আসেনি, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতও আচমকা আসেনি। স্বাধীনতা এসেছে পর্যায়ক্রমে এবং সেইসব পর্যায়ের প্রতিটি পর্যায়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানকেই জাতীয় সংগীত হিশেবে ভেবে রাখা হয়েছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই এই গানকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিয়ে গাওয়া হয়েছে, এই গান কাজ করেছে দেশ স্বাধীন করার সাংস্কৃতিক মন্ত্র হিশেবেও। বাংলাদেশের সম্ভাব্য জাতীয় সংগীত যেহেতু দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে; তাই, এই গানে যুদ্ধের প্রসঙ্গ নেই, শহিদদের উল্লেখ নেই। মোদ্দা কথা— বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ গান পরস্পরের সাথে বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা না, এরা বরং একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এজন্যই, ১৯৭২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচনের জন্য সরকারকে মোটেই বেগ পেতে হয়নি, জাতীয় সংগীত হিশেবে তখন ‘আমার সোনার বাংলা’ই হয়ে উঠেছিল স্বয়ংক্রিয় পছন্দ।

বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রথম উদ্যোগ এসেছিল খন্দকার মোশতাক আহমেদের হাত ধরে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর মোশতাক রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন তিরাশি দিন। এই ক’দিনেই তিনি বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ পালটে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর আদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ করেছিলেন, বাংলাদেশ বেতারের নাম ‘রেডিও পাকিস্তান’-এর আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করেছিলেন এবং উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে সম্পৃক্ত সবকিছুকেই বদলে ফেলে তিনি পাকিস্তানি ভাবাদর্শ চালু করতে চেয়েছিলেন এবং এরই অংশস্বরূপ জাতীয় সংগীতেও হাত দিয়েছিলেন। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য তিনি উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন, সেই কমিটির প্রধান করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক কাজী দীন মুহম্মদকে, নির্দেশ দিয়েছিলেন এক মাসের মধ্যে নতুন জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করতে। দীন মুহম্মদ কমিটি এ-ব্যাপারে তিনটি বৈঠক করে এবং দুটো গানের যেকোনো একটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব দেয়— কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরি’। কিন্তু অভ্যুত্থান-পালটাঅভ্যুত্থানের ডামাডোলে মোশতাক জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করে যেতে পারেননি।

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো— কাজী দীন মুহম্মদ ছিলেন পাকিস্তানের একজন দালাল শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধকালে ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর যে-পাঁচসদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল পশ্চিম পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল, দীন মুহম্মদ ছিলেন সেই পাঁচজনের একজন। বাকি চারজন ছিলেন অবজার্ভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের মালিক হামিদুল হক চৌধুরী, পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মাহমুদ আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাজ্জাদ হোসেন এবং বিচারপতি নুরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের দালালি করার অপরাধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষককে স্বাধীন বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছিল, দীন মুহম্মদ তাদের অন্যতম। দীন মুহম্মদের ব্যাপারে এই তথ্যগুলোর উৎস মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র কর্তৃক ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত বই ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’। দীন মুহম্মদ যে-ফররুখ আহমদের কবিতাকে জাতীয় সংগীত হিশেবে প্রস্তাব করেছিলেন, মজার ব্যাপার হলো— মুক্তিযুদ্ধকালে সেই ফররুখও পাকিস্তানের দালাল ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৭ মে সংবাদপত্রে যে-পঞ্চান্ন বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন; তাদের তালিকার দীন মুহম্মদও আছেন, ফররুখও আছেন। পঞ্চান্নজনের পুরো তালিকা পাওয়া যাবে ঐ একই বইয়ে (একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়)। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ হওয়ার পর সেই নিষেধাজ্ঞার পক্ষে যে-চল্লিশ বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়েছিলেন, ফররুখ তাদেরও একজন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে ফররুখ লেখালিখি করেছিলেন বিধায় স্বাধীন দেশে তিনি বেতারের চাকরি খুইয়েছিলেন, যুদ্ধের পর বাংলা অ্যাকাডেমিতে তার প্রবেশ অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল এবং ১৯৭৪ সালে মৃত্যুর পর তাকে কবরস্থ করার জায়গা নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কবি বে-নজীর আহমদ শাহজাহানপুর পারিবারিক কবরস্থানে ফররুখকে কবর দেওয়ার জায়গা করে দেন। উল্লেখ্য, বে-নজীরও স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তোলা হয়েছিল প্রকাশ্যে। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে তৎকালীন বিমানবাহিনীপ্রধান গোলাম তাওয়াব একটি ‘সিরাত মাহফিল’-এর আয়োজন করেছিলেন। তারিখ হিশেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ৭ মার্চকেই, কারণ পাঁচ বছর আগের এই দিনে শেখ মুজিবুর রহমান একই মাঠে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সিরাত মাহফিলে বক্তব্য রাখেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, যাদের অধিকাংশই বাহাত্তরের দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত। বক্তব্য রাখেন তরুণ মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও। স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে একযোগে মাঠে নামালে মুক্তিযোদ্ধারা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান, তা পরখ করে দেখাই ছিল ঐ মাহফিল আয়োজনের উদ্দেশ্য। আলোচ্য মাহফিল থেকে দাবি ওঠে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের, এমনকি বাংলাদেশকে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণারও। সেই মাহফিলে স্লোগান দেওয়া হয়েছিল— ‘মোদের নেতা তাওয়াব ভাই, চান-তারা পতাকা চাই।’

১৯৭৮ সালের ১২ ডিসেম্বর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেট অধিবেশনে কোরান তেলাওয়াতের আগে জাতীয় সংগীত গাওয়ায় জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম জেলা বিএনপির নেতা ডা. ইউসুফ বলেছিলেন— ‘স্যার, আমাদের পতাকায় ইসলামি রং নেই, এটা আমাদের ভালো লাগে না। এটা ইসলামি তাহজ্জিব ও তমুদ্দুনের সাথে মিলছে না।’ উত্তরে জিয়া বলেছিলেন— ‘হবে, হবে। সবকিছুই হবে। আগে হিন্দুর লেখা জাতীয় সংগীত বদলানো হোক। তারপর জাতীয় পতাকার কথা ভাবব।’ ডা. ইউসুফ ও জিয়াউর রহমানের এই কথোপকথন পেয়েছি সাংবাদিক আবেদ খানের ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি বইয়ে। তবে, অভিযোগ আছে— সাংবাদিক হিশেবে আবেদ খান আওয়ামি লিগ-অনুগত। তাই, তার বইয়ের বক্তব্য বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করতে হবে নিজ দায়িত্বে। ওদিকে ১৯৭৮ সালেরই ৮ মে ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— ‘জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা বদলানোর ব্যাপারে কোনো-কোনো মহল হইতে দাবি উঠিয়াছে। সে-সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?’ এর জবাবে জিয়া বলেছিলেন— ‘এগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা যায় না। এগুলি পারমানেন্সির ভিত্তিতেই গ্রহণ করা হয়।’

জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এর পরের বছর। ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব আসে। ঐ সময়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ্‌ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে মন্ত্রিপরিষদকে লেখেন— ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থি বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’ ঐ চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’-কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন শাহ্‌ আজিজ (গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির, সুরকার আলাউদ্দিন আলী)। প্রধানমন্ত্রীর ঐ চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে। এ-সময়ে রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পরিকল্পনা ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর থেমে যায়। এই অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত তথ্যগুলো নিয়েছি দৈনিক যুগান্তরের ২০১৯ সালের ৭ আগস্টের অনলাইন সংস্করণ থেকে। উল্লেখ্য— মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করার দায়ে শাহ্‌ আজিজুর রহমান বাহাত্তরের দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি পেয়েছিলেন। মুক্তি পেয়ে আবারও তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং ১৯৭৪ সালে আবারও গ্রেপ্তার হন।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তোড়জোড় খালেদা জিয়ার আমলেও দেখা গিয়েছিল। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামির আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। তাতে বলা হয়— ‘সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন।’ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া চিঠিটা প্রত্যাখ্যান না-করে সংস্কৃতিমন্ত্রণালয়ে পাঠান। সংস্কৃতিমন্ত্রী বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে সচিবের কাছে প্রেরণ করেন। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনকে সংস্কৃতিমন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারবহির্ভূত বিষয় অভিহিত করে সচিব তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠান। একই বছরের ১৯ আগস্ট প্রস্তাবটি সংস্কৃতিমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই সরকারের আমলে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। এই অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত তথ্যগুলোও নিয়েছি দৈনিক যুগান্তরের ২০১৯ সালের ৭ আগস্টের অনলাইন সংস্করণ থেকে। উল্লেখ্য— মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা সংঘটনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার দায়ে নিজামী-মুজাহিদ উভয়েরই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তোলার উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি হলো সংক্ষেপে এই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদ্যোগের কথা শুনেছি, তবে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সাংবাদিকসম্মেলন ডেকে সম্প্রতি একই দাবি তুলেছেন গোলাম আজমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি। ‘মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস’ তুলে ধরার জন্যও আজমি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ‘সঠিক ইতিহাস’-এ বাবা আজমের অবস্থান কী বা কোথায়, পুত্র আজমি তা উল্লেখ করেননি। একই সাংবাদিকসম্মেলনে তিনি তার বাবাকে উলটো ‘সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিশেবে সাব্যস্ত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম আজম ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামির আমির এবং ছিলেন একাত্তরের গণহত্যার শীর্ষ-কুশীলবদের একজন। গোলাম আজম বাংলাদেশের শুধু জন্মের বিরোধিতা করেছিলেন, তা না। যুদ্ধে পরাজয় আঁচ করতে পেরে একাত্তরের নভেম্বরেই তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। বাংলাদেশের বিরোধিতা তিনি যে কেবল যুদ্ধকালেই করেছিলেন, তা-ও না। যুদ্ধশেষেও তিনি পাকিস্তানে বসে বাংলাদেশবিরোধিতা অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে গোলাম আজম ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার সপ্তাহ’ পালন করেন, লন্ডনে গিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার’ কমিটি গঠন করেন। সৌদি আরবে আন্তর্জাতিক যুবসম্মেলনে গিয়ে তিনি মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোকে আহ্বান জানান বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিশেবে স্বীকৃতি না-দেওয়ার জন্য এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে কোনো সহযোগিতা না-করার জন্য। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, গোলাম আজম তাতেও বিরোধিতা করেছিলেন। সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে আজম চেষ্টা করেছিলেন দুই দেশকে নিয়ে একটা কনফেডারেশন গড়ে তুলতে। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৮ সালে মা মারা যাওয়ার পর জিয়াউর রহমান সরকার গোলাম আজমকে বিনা ভিসায় পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসতে দিয়েছিলেন। সেই যে এলেন, তিনি পাকিস্তানে আর ফিরে গেলেন না। পরবর্তী ষোলো বছর তিনি বিদেশী নাগরিক হিশেবে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সরকারগঠনে বিএনপিকে সহযোগিতার পুরস্কারস্বরূপ ১৯৯৪ সালে আদালতের রায়ের মাধ্যমে গোলাম আজম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন।

উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছিলেন; সামান্য চোখ বোলালেই দেখা যায়— এদের প্রত্যেকেই হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বুদ্ধিজীবী অথবা বাহাত্তরের দালাল আদেশে দণ্ডপ্রাপ্ত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিশেবে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত বা নব্বই বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতা কিংবা কোনো যুদ্ধাপরাধীর সন্তান। এদের সমস্যা কেবল জাতীয় সংগীতে না; জাতীয় পতাকা, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহিদমিনার, বাংলা বর্ষবরণ— এদের সমস্যা সবকিছুতেই। জাতীয় সংগীতে বা ‘আমার সোনার বাংলা’য় যাদের আপত্তি আছে; স্মৃতিসৌধ বা শহিদমিনারে ফুল দেওয়াও তাদের কাছে হারাম, শিখা চিরন্তনও হারাম, পান্তা-ইলিশও হারাম। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলাদেশের জন্মের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট সবকিছুতেই এদের আপত্তি। কারণ শহিদমিনারের ইতিহাস পাকিস্তানরাষ্ট্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরির ইতিহাস, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ইতিহাস রেসকোর্স ময়দানে তিরানব্বই হাজার সৈন্যসহ পতিত পাকিস্তানরাষ্ট্রের আত্মসমর্পণের ইতিহাস, জাতীয় স্মৃতিসৌধের সাত স্তম্ভের ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির সাতটি প্রলয়ঙ্কর পর্বের ইতিহাস (ভাষা-আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সংবিধান-আন্দোলন, শিক্ষা-আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ)। একাত্তরে এরাই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গালি দিতেন ‘কাফের-মুরতাদ’ বলে, ডাকতেন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে, সাব্যস্ত করতেন ‘রুশ-ভারতের চর’ বলে। একাত্তরের পর এরাই চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের জন্মের সাথে সম্পৃক্ত সবকিছুকে সমূল উৎপাটন করতে।

আগেই উল্লেখ করেছি— ‘আমার সোনার বাংলা’ হঠাৎ করে এক রাতের মধ্যে জাতীয় সংগীত হয়ে যায়নি, হয়েছে বছরের পর বছর ধরে ক্রিয়াশীল ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আবার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আওয়াজও হঠাৎ নয়। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর খন্দকার মোশতাকের হাত ধরে, এই আওয়াজের সর্বশেষ প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের পুত্র আবদুল্লাহিল আমান আজমির কণ্ঠে। মধ্যবর্তী ঊনপঞ্চাশ বছরে পাকিস্তানপন্থি বহু বাঙালি বুদ্ধিজীবী জাতীয় সংগীত হিশেবে ‘আমার সোনার বাংলা’-কে বহুভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন, ওয়াজ মাহফিলের সিকি-শিক্ষিত বক্তারা এই গানে হিন্দুয়ানি উপকরণ ও শেরেক খুঁজে পেয়েছেন, মাদ্রাসাগুলো বন্ধ রেখেছে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া। মুক্তিযুদ্ধকালে অল্পকিছু বাদে অধিকাংশ মাদ্রাসারও ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। ফলে, এ-কথা আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না— জাতীয় সংগীত হিশেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ যাদের পছন্দ না; তারা কারা, তাদের উদ্দেশ্য কী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে তাদের অবস্থান কী।

রবীন্দ্রবিরোধীদের কেউ-কেউ বলছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ বা কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানকে জাতীয় সংগীত করতে। কিন্তু যেসব অভিযোগ ‘আমার সোনার বাংলা’র বিরুদ্ধে আছে, এই দুই গানও তা থেকে মুক্ত না। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’র একটি বাক্য— ‘ও মা, তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি।’ চাইলে দ্বিজেন্দ্রলালের এই ‘মা’-কে ‘মা কালী’ আখ্যা দিয়ে এই গানেও হিন্দুত্ব বা শেরেক খোঁজা যায়, একই জিনিশ খোঁজা যায় নজরুলের ‘চল চল চল’ গানের ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’ বাক্যেও। তদুপরি দ্বিজেন্দ্রলাল আবার অমুসলমান। ওদিকে দ্বিজেন্দ্রলাল-নজরুল কারো জন্মই বাংলাদেশে না, দুজনেরই জন্মস্থান রবীন্দ্রনাথের রাজ্যে। এর ওপর নজরুল আবার হিন্দুদের শ্যামাসংগীতও লিখে বসে আছেন, ভগবান-বুকে পদচিহ্ন আঁকতে চেয়েছেন, মসজিদের তালা ভাঙতে চেয়েছেন, ছেলের নাম রেখে বসে আছেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। কারো-কারো অভিযোগ— ‘আমার সোনার বাংলা’ গানে সরাসরি ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি নেই, বাংলাদেশের অবাঙালি আদিবাসীদের উল্লেখ নেই। ঘটনা হলো— ‘বাংলাদেশ’ শব্দ ‘ধনধান্য পুষ্পভরায়’ও নেই, ‘চল চল চল’ গানেও নেই। আর একইসাথে বাঙালি-অবাঙালি সবার কথা উল্লেখ আছে, এমন কোনো গান অদ্যাবধি রচিত হয়নি; যা দেশের জাতীয় সংগীত হওয়ার উপযোগী। রবীন্দ্রনাথের ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানে ‘বাংলাদেশ’ আছে, কিন্তু এই গানেরই অন্য দুটো বাক্য— ‘ও গো মা, তোমার কী মূরতি আজি দেখি রে’ এবং ‘হৃদয় আজি ভরে গেছে সোনার মন্দিরে’। তাই, এই গানও ‘মূরতি’ আর ‘মন্দির’-এ মার খেয়ে যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ভাবধারার সাথে সংঘর্ষ বাধিয়ে ফেলে। ফলে, অজুহাত খুঁজতে চাইলে নানানভাবেই খোঁজা যাবে, শতভাগ বিতর্কমুক্ত বা সর্বজনগ্রহণযোগ্য কোনো জাতীয় সংগীত খুঁজে পাওয়া কস্মিনকালেও সম্ভব হবে না।

একটা মজার ব্যাপার এখানে উল্লেখ না-করলেই না। ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্মের অন্তত ছেষট্টি বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এর আগে কেউ ‘বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, এমনটি অদ্যাবধি চোখে পড়েনি। বলাই বাহুল্য— ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের নামকরণ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই গানের সূত্র ধরেই। রবীন্দ্রনাথে যাদের বিপুল ব্যারাম, তারা শেষমেশ ‘বাংলাদেশ’ নামও পালটাবেন কি না; এ-ব্যাপারে অবশ্য কোনো উচ্চবাচ্য শুনিনি। রবীন্দ্রনাথ এমনই এক মহাসমুদ্র; যার বুক থেকে কয়েক কলসি পানি তুলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যায়, কিন্তু পুরোটা সেচে ফেলা যায় না। সব নদীকে যেমন কোনো-না-কোনোভাবে সাগরে মিশতেই হয়, তেমনি ১৮৬১-পরবর্তী গোটা বাঙালি জাতিকেই রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে কিছু-না-কিছু ধার নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ এমনই এক ব্যাংক, যার কাছে পুরো উপমহাদেশ এবং অবিভক্ত বাঙালি জাতি সরাসরি দায়বদ্ধ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ-কেউ বলছেন— জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ই থাকুক, তবে এই গানের ‘মা’ শব্দটি পালটে অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করা হোক। তাদের কাছে এই গানের ‘মা’ হিন্দুয়ানির পরিচায়ক। মজার ব্যাপার হলো— ভারতের জাতীয় সংগীতেরও একটি শব্দ পরিবর্তনের জন্য দাবি উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। ভারতের জাতীয় সংগীতের প্রথম পঙ্‌ক্তির পরপরই চলে আসে— ‘পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, মারাঠা, দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গ; বিন্ধ্য, হিমাচল, যমুনা, গঙ্গা— উচ্ছল জলধিতরঙ্গ।’ কিন্তু গানটি লেখার সময়ে (১৯১১) ‘সিন্ধু’ ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও দেশভাগের পর তা পাকিস্তানের অধীনে চলে যায়। তাই, ‘সিন্ধু’ শব্দটিকে পালটে ‘কাশ্মীর’ শব্দটি যোগ করার দাবি ওঠে ২০০৫ সালে। এই দাবির বিরোধীরা পালটা-যুক্তি দেন— জাতীয় সংগীতে ‘সিন্ধু’ শব্দটি কেবল ‘সিন্ধু প্রদেশ’ নয়, বরং সিন্ধু নদ ও ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ সিন্ধি ভাষা ও সংস্কৃতিরও পরিচায়ক। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তি মেনে নিয়ে জাতীয় সংগীতের ভাষায় কোনোরূপ পরিবর্তনের বিপক্ষে মত দেয় এবং সাফ জানিয়ে দেয়— রবীন্দ্রনাথের লেখায় কোনো কাটাছেঁড়া চলবে না। ২০১৮ সালে, আবারও, জাতীয় সংগীত থেকে ‘সিন্ধু’ শব্দটি বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আসাম রাজ্যসভার কংগ্রেস-দলীয় এক সদস্য; নাম— রিপুন বোরা। সিন্ধুর জায়গায় তিনি ‘উত্তর-পূর্ব’ ব্যবহারের দাবি জানান। কিন্তু রিপুন নামের এই ছন্দজ্ঞানহীন ব্যক্তিটি জানেনই না— ‘সিন্ধু’ শব্দ দুই মাত্রার আর ‘উত্তর-পূর্ব’ চার মাত্রার। দুই মাত্রার একটি শব্দ অপসারণ করে চার মাত্রার শব্দ বসালে তা যে আর গাওয়া যাবে না, দাঁতের মাঢ়ি খুলে পড়ে যাবে— এইটুকু বোধ তার নেই। মোদ্দা কথা— রবীন্দ্রনাথকে রেখে দেওয়া যায়, বাদ দেওয়া যায়; কিন্তু রবীন্দ্রনাথে অস্ত্রোপচার চলে না।

উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বিরুদ্ধে হঠকারিতার আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতার বুকে গুলি চালিয়ে উর্দুর বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে বাধা দিয়ে এবং রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন নিষিদ্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরো শক্তিশালীভাবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্ত প্রতিচ্ছবি এবং তার রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ও এখন থেকে একশো উনিশ বছর আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত একটি ঐতিহাসিক গান। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা এই গানকে জাতীয় সংগীত হিশেবে ব্যবহার শুরু করেছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই। তাই, এই গানকে জাতীয় সংগীত থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ধারাবাহিকতার সুতো কেটে দেওয়া, স্বাধীনতাসংগ্রামীদের আবেগ-অনুভূতিকে কবরস্থ করা, মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারকে অস্বীকার করা, স্বাধীনতাবিরোধী সম্প্রদায় ও তাদের উত্তরসূরিদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয় নিশ্চিত করা। শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার মৃত্যুর পর জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে অসংখ্যবার। সেসব চেষ্টার একটিও সফল হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুতীব্র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন হয়েছে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার। হাসিনার মহাপলায়নের পর জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের সুর তুলেছেন গোলাম আজমের ব্রিগেডিয়ার পুত্র।

মনে রাখতে হবে— ‘আমার সোনার বাংলা’ শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, পৈত্রিক সম্পত্তিও নয়; এই গানকে শেখ হাসিনাও জাতীয় সংগীত বানাননি, তার পিতার একক ইচ্ছেয়ও এই গান জাতীয় সংগীত হয়নি। ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হয়েছে একটি নিরবচ্ছিন্ন, ধারাবাহিক ও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এই নিরবচ্ছিন্নতাকে বিচ্ছিন্ন করার, ধারাবাহিকতাকে অধারাবাহিক করার কিংবা ঐতিহাসিকতাকে ইতিহাসচ্যুত করার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের জন্ম যারা চায়নি, ‘আমার সোনার বাংলা’র ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি তাদের সম্মিলিত বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির চেয়ে যোজন-যোজন বেশি।

৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

নিলয় আর্য্

বাংলাদেশের মানুষজন পড়াশোনা থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন আর গুজবসম্রাট তার প্রমাণ পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তারই একটা সাম্প্রতিকতম প্রমাণ “গগন হরকরার আমি কোথায় পাব তারে গানের সুর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সঙ্গীতের সুর চুরি করেছিলেন” এই জাতীয় প্রোপাগাণ্ডা। স্বাভাবিকভাবেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী সাহিত্যিক যিনি কিনা পৃথিবীর ইতিহাসের ই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক তাঁর নাম “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”, এই অলঙ্ঘনীয় সত্যের ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে রাতের পর রাত ক্রন্দনরত নির্ঘুম রজনী পারি দেয়া সহজ বিষয় নয়।

কিন্তু কে এই গগন হরকরা? কবিগুরু তাঁর সুর চুরি করেন নি, বরং নিতান্তই গ্রামীণ এক ডাকঘরের হরকরাকে নিজ উদ্যোগে সাহিত্য জগতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তার মেধা ও গুণকে মূল্যায়ন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ না চাইলে আপনি আমি কখনও শুনতাম ই না তার নাম।

গগন হরকরার আসল নাম গগনচন্দ্র ড্যাম, তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহের এক পোস্ট অফিসের ডাক হরকরা বা ডাকপিয়ন ছিলেন যিনি চিঠি বিলি করতেন। ছিলেন লালন ফকিরের একনিষ্ঠ ভক্ত ও বাউল গায়ক। গগন হরকরার জীবনের ছায়া অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ডাকঘর নাটকটি, নাটকের গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর চরিত্রটি মূলত গগন হরকরা। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে নিয়মিত জমিদারী দেখাশোনা করতে যেতেন। তখন শিলাইদহে তাঁর সঙ্গে গগনের পরিচয় হয়েছিল। গগণ তাকে গান গেয়ে শোনাতেন। শিলাইদহে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি পৌঁছে দিতেন এবং সংগ্রহ করতেন। ইন্দিরা দেবীর কাছে ছিন্নপত্রে জমা হওয়া চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে বহুবার লিখেছেন।

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গগন হরকরা, গোঁসাই গোপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী, গোঁসাই রামলাল এবং লালনের অজস্র শিষ্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। লালন ও বাউল সঙ্গীতের ভক্ত কবিগুরু শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া অঞ্চল হতে অনেক বাউল গান সংগ্রহ ও করতেন এবং তারপরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেগুলো প্রচার করার ব্যবস্থা করতেন। উদ্দেশ্য ছিল যাতে সুধী সমাজের মধ্যে বাংলাদেশের বাউল গান সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে।

অধ্যাপক মনসুরউদ্দিনের বাংলা লোকগীতি নিয়ে ১৩ খণ্ডের অমর রচনা হারামণি। সেই গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ভূমিকা আবার লিখেছেন বাউল-লালন-লোকগানের সর্বশ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ভূমিকাতেই কবিগুরু গগন হরকরার আমি কোথায় পাব তারে গানের কথা উল্লেখ করেন-

“আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল–

কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে!

হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে

দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে….

কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এই কথাটিই উপনিষদের ভাষায় শোনা গিয়েছে : তং বেদ্যং পুরুষং বেদ মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথাঃ। যাঁকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণবেদনা। অপণ্ডিতের মুখে এই কথাটিই শুনলুম তার গেঁয়ো সুরে সহজ ভাষায়–যাঁকে সকলের চেয়ে জানবার তাঁকেই সকলের চেয়ে না-জানবার বেদনা–অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু তারই কান্নার সুর–তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে। ‘অন্তরতর যদয়মাত্মা’ উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলুম, আমার মনে বড়ো বিস্ময় লেগেছিল। এর অনেক কাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না–তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্যরচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করি নে।”

রবীন্দ্রনাথ এভাবেই বেদ-উপনিষদের অমর শিক্ষাকে বাউল সঙ্গীতের মাধ্যমে সহজ ভাষায় প্রকাশিত হতে দেখে আপ্লুত হতেন। এত অসামান্য শিল্পকে তিনি সর্বত্র প্রচার, প্রসার করার জন্য সর্বদা ছিলেন তাই উন্মুখ। “আমি কোথায় পাব তারে” গানটি যে গানটির সুর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সুর, না চুরি করে নয়, সর্বত্র ঢাকঢোল পিটিয়ে গগন হরকরার ভূয়সী প্রশংসা ও শ্রদ্ধার্পণের মধ্যে দিয়ে, সেই গানটি ছিল উপনিষদের অমর বাণীর ই সহজ সরল প্রকাশ। আমাদের মাটি আবহমান কাল ধরে এই অমর গ্রন্থগুলোর সাথে কত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে তা আসলে গভীর অধ্যয়ন ছাড়া অনুধাবন করা অসম্ভব। আর এই বিষয়টিই সকলের কাছে ছড়িয়ে দিতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩২২ বাংলার বৈশাখ সংখ্যায় ‘হারমণি’ বিভাগ চালু হলে ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’-ভাবতত্ত্বের এ গান দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিভাগের সূচনা করেন।

পণ্ডিত ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রি বলেছেন: “লালন-এর শীর্ষ ধারার একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের ডাক হরকরা–যাঁর নাম গগন। রবীন্দ্রনাথ গগনকে সবার মাঝে বিভিন্ন ভাবে পরিচিত ও বিখ্যাত করে যথাসাধ্য মূল্যায়ন করেছেন।”

প্রথমবার গগন হরকরার সাথে দেখা হলে রবীন্দ্রনাথকে তিনি গেয়ে শোনান “আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যারে”, শুনে অভিভূত রবীন্দ্রনাথ গগণের নাম ও তার গানটির বিষয়ে তার প্রবন্ধ “An Indian Folk Religion” এ উল্লেখ করে বলেন, “The first Baul song, which I chanced to hear with any attention, profoundly stirred my mind.”

কবিগুরুর মন্ত্রশিষ্য ও ছায়া সঙ্গী শান্তিদেব ঘোষ আরও লিখেছেন যে-

“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায়

ভালবাসি” গানটি তিনি (গুরুদেব) রচনা করেছেন “গগন হরকরার রচনা—

‘আমি কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে ||

হারায় সেই মানুষে তার উদ্দিশে

দেশ বিদেশে

আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে’ গানটির সঙ্গে মিলিয়ে |”

(শান্তিদেব ঘোষ, রবীন্দ্র সংগীত, পৃষ্ঠা-১৩০)

সত্যেন রায় লিখেছেন- “বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ আগস্ট (১৯০৫ খৃ:) কলিকাতার টাউন হলে যে সভা হয়েছিল, সেই উপলক্ষ্যে… রবীন্দ্রনাথ নূতন সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ বাউল সুরে গীত হয়েছিল।”

জেনে রাখা ভালো এই সুরগুলো সংগ্রহ করে রাখতেন রবীন্দ্রনাথেরই বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে সরলাদেবী।

সরলাদেবী তাঁর জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন— “কর্তাদাদামহাশয় চূঁচড়ায় থাকতে তাঁর ওখানে মাঝে মাঝে থাকবার অবসরে তাঁর বোটের মাঝির কাছ থেকে অনেক বাউলের গান আদায় করেছিলুম। যা কিছু শিখতুম তাই রবিমামাকে শোনাবার জন্যে প্রাণ ব্যস্ত থাকত— তাঁর মত সমজদার আর কেউ ছিল না। যেমন যেমন আমি শোনাতুম—অমনি অমনি তিনি সেই সুর ভেঙ্গে, কখনো কখনো তার কথাগুলিরও কাছাকাছি দিয়ে গিয়ে একখানি নিজের গান রচনা করতেন। কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, আমার সোনার বাংলা প্রভৃতি অনেক গান সেই মাঝিদের কাছ থেকে আহরিত আমার সুরে বসান।”

সরলা দেবী চৌধুরানী ইতিপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে কবিগুরুর সহায়তায় তার শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশী গানের সুরই এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিল। সরলা দেবী চৌধুরানী ঠাকুর পরিবারের মুখপত্র ভারতী পত্রিকায়

“লালন ফকির ও গগন ” শিরোনামের একটি প্রবন্ধও প্রকাশ করেছিলেন । এই রচনাটিতে গগনের দুটি গান অন্তর্ভুক্ত ছিল – “আমি কোথায় পাবো তার” এবং “(ও সোম) আসর মায়াই ভুলে রবে”। ১৩২২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ প্রথম হরকরার গান তাঁর প্রবাসী পত্রে প্রকাশ করেন।

অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ সাহচর্যেই বাউলদের গ্রামীণ সঙ্গীতসমূহ বিদ্বৎসমাজে প্রকাশিত হয়, তিনিই গগন হরকরা ও তাঁর গানটিকে পরিচয় করিয়ে দেন বিশ্বমাঝে এবং সকলকে জানিয়েই তিনি তাঁর লিখিত গীতিকাব্যে এই সুর সমূহ আরোপ করে এদেরকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেন। আর আজ পাড়ার সালেক মালেকও এই অমর অবদানকে চুরি বলে ফেসবুকে পোস্ট করছে, চারদিকে এতই অশিক্ষা!

স্বরবিতান ষট্‌চত্বারিংশ (৪৬) খণ্ডে মুদ্রিত স্বরলিপিতে গানটির রাগ ও তালের উল্লেখ নেই। বাউল গানের সুরে এর সুর নিবদ্ধ। তাই গানটিকে বাউলাঙ্গও বলা হয়।

শেষ করব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি গল্পের মাধ্যমে।

শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে এক জমজমাট দুপুর। বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের সকলের প্রিয় সঙ্গীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি জমিদারের বন্ধু, জমিদার রবীন্দ্রনাথ। দুই সঙ্গীতজ্ঞ যেখাবে সেখানে এসব গানবাজনা তো হবেই। হারমোনিয়াম বাজিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল বেশ রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করলেন “বাহবা, বাহবা নন্দলাল”। সকলেই বাহবা, বাহবা করতে লাগল।

জমিদার মশাইয়ের গলায় আজ অল্প ব্যথা। তিনি বন্ধুবরকে বললেন, আমার গান তো শুনেছেন অনেক, আজ এর গান শুনুন। সামনে সংকুচিত হয়ে বসে থাকা এক রোগা-হ্যাংলা মানুষের দিকে নির্দেশ করতে সে আরো কাঁচুমাচু হয়ে গেল। ভাবটা যেন, সত্যি আমাকে ডাকছেন? একে এলাকার সবাই চেনে। দ্বিজুবাবুকে এর পরিচয় দেওয়া হলো, এখানকার ডাকঘরের ডাক হরকরা, এর নাম গগন। আপনারা লালন ফকিরের গান তো শুনেছেন নিশ্চয়, এবার এর গান শুনুন। গগনের দিকে একবার তাকিয়ে কার উদ্দেশ্যে যেন নমস্কার ঠুকে গগন গান ধরলেন-

কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে!

হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে

দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে

লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী

পেলে মন হত খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।

আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে

মরি হায় হায় রে

ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে

ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।

…উদাত্ত কণ্ঠে এই মাটির প্রাণের গান, গাওয়া শেষ হলেও অনেকক্ষণ কারো মুখ দিয়েই কথা বেরোলো না।

এভাবেই বাংলার মাটির কাছের বাউল সঙ্গীতকে তুলে নিয়ে এসে অমরত্ব এনে দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এবং বারেবারে এই সঙ্গীতসমূহের সূর স্রষ্টাদের স্মরণ করেছেন জগৎসংসারের সম্মুখে। তিনি আজীবন লালনের গানে, বাউলের সুরে খুঁজে বেড়িয়েছেন সেই জ্যোতির্ময়কে যা তাঁর রচিত আরও একটি বাউল সুরারোপিত অমর গীতিকাব্যে আজও বাজে-

পথিক কয়, “ভেবো না রে ডুবে যাও রূপসাগরে

বিরলে বসে করো যোগ-সাধনা

তারে ধরি ধরি মনে করি

ধরতে গেলেম, আর পেলেম না

দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা…

তথ্যসূত্র-

১.শান্তিদেব ঘোষ, রবীন্দ্র সংগীত

২. রবিজীবনী- প্রশান্ত কুমার পাল

৩. প্রথম আলো (১ম খন্ড) – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

৪. হারামণি, মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন

৫. অন্তর্জাল

লেখা : নিলয় আর্য

To top